করোনায় মৃতদের জন্য দেশেই তৈরি হচ্ছে বডিব্যাগ

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলে নানা জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে লাশ দাফনে। মৃতের দেহ থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দাফনের ক্ষেত্রে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এ রকম ঘটনায় শেষপর্যন্ত প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সতর্কতার সঙ্গে লাশ দাফন করা হয়। তবে সেই ভয় এখান নেই, কেননা সৎকারের কাজে ব্যবহার হচ্ছে বডিব্যাগ। আর এই বডিব্যাগ এখন বাংলাদেশেই তৈরি হচ্ছে।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে বা উপসর্গ নিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের সৎকারের কাজে বডিব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। বডিব্যাগ সাধারণত ওয়াটার-প্রুফ মানে পানি নিরোধক। এটি তৈরি করতে সাধারণত ভেতরে দুই পরতে পলি প্রোপাইলিন দিয়ে তৈরি কাপড় ব্যবহার করা হয়। এর মাথাগুলো এমন ভাবে মুড়ে দেয়া হয়, যাতে মৃতদেহ থেকে কোন জলীয় পদার্থ বা তরল ব্যাগের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

বহন করার জন্য এর চারপাশে চারটি থেকে আটটি হাতল থাকে। সামনের অংশে চেন লাগানো থাকে।

বডিব্যাগ কী?

সারা পৃথিবীতে মরদেহ পরিবহনের জন্য বিশেষত দূর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু হলে সৎকারের জন্য বডিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হবার পর, এতে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে বা কোভিড-১৯ এর উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফনে বডিব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে, যে কারণে এখন অনেক বেশি শোনা যাচ্ছে এর কথা।

বিশেষত মহামারি শুরুর পর প্রথমদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ছিল, মৃতদেহ থেকে যাতে ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য বিশেষভাবে তৈরি ব্যাগে মৃত ব্যক্তির কবর দিতে হবে। বাংলাদেশে একেবারে প্রথমদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু ব্যাগ সরবারহ করে, পরে সরকারও কিছু ব্যাগ আমদানি করে।

শুরুতে মরদেহ বহনের যে ব্যাগগুলো ব্যবহার করা হত, সেগুলো চীন থেকে আসত। পরে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী দেশেই এগুলো বানাতে শুরু করেন। এখন স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাছ থেকেই কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের অর্থাৎ সিএমএসডি’র মাধ্যমে বডিব্যাগ কিনছে সরকার।

কারা তৈরি করছে?

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২৮শে জুন পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৭৩৮ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৮৮৪ জন ব্যক্তির দাফন করেছে বেসরকারি সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা। এই প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত মোট ৭০০ জনকে নিজেদের তৈরি বডিব্যাগে দাফন করেছে।

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাফন কার্যক্রমের সমন্বয়ক সালেহ আহমেদ বিবিসিকে বলেছেন, শুরুর দিকে সরকারের সরবারহ করা ব্যাগ ব্যবহার করতেন তারা। তিনি বলেন, “আমাদের একটি গবেষণা সেল আছে, তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী বডিব্যাগের মাপ এবং গুনগত মান অনুসরণ করে একটি মডেল তৈরি করে, যা সরকারি সংস্থার কাছ থেকে আমরা পরে অনুমোদন পাই।”

তিনি কারও বলেন, “এখন আমাদের নিজেদের তৈরি বডিব্যাগেই দাফনের কাজটি করছি আমরা। এখন পর্যন্ত ১৩৯৮টি বডিব্যাগ বানিয়েছি আমরা, আরো উৎপাদন চলছে”।

দাতব্য প্রতিষ্ঠানের বাইরে তৈরি পোশাক খাতেও এখন বডিব্যাগ তৈরি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ১২টির মত প্রতিষ্ঠান এ কাজে যুক্ত রয়েছে। তবে ঠিক কতগুলো প্রতিষ্ঠান বডিব্যাগ তৈরি করছে, তার হিসাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই।

ঢাকার শ্যামলীতে ডি স্মার্ট ইউনিফর্ম সল্যুশন নামের প্রতিষ্ঠানটি বডিব্যাগ তৈরি করে মূলত কিছু দাতব্য সংস্থাকে সরবরাহ করার জন্য। যারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফন করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মাইনুল হাসান পাটোয়ারি বিবিসিকে বলেছেন, এ পর্যন্ত দুই হাজার ব্যাগ বানানোর অর্ডার পেয়েছেন তারা।

তিনি বলেন, সাধারণত একটি বডিব্যাগের দাম মান অনুযায়ী ৬৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। অন্যদিকে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মি. আহমেদ বলছিলেন, একটি বডিব্যাগ তৈরিতে তাদের খরচ হয় ১৩০০ টাকার মত।

পরিবেশগত ঝুঁকি কতোটা?

বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফনে যে বডিব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে পলিথিনের কাঁচামাল পলি প্রোপাইলিন। যা মাটিতে মিশে যায় না। ফলে তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক নাসরিন রফিক বলছেন, “মহামারির কারণে মানুষ অনেক ভীত ও বিহ্বল অবস্থায় রয়েছে, যে কারণে এখনো এদিকে দৃষ্টি যায়নি লোকের। কিন্তু এই বডিব্যাগের কারণে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে, কারণ এটা বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয়।”

তিনি বলেন, “কত মানুষ মারা যাবে, তার ওপর পরিবেশের এই ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে। সন্দেহ নেই দীর্ঘদিন এই ক্ষতি বহন করতে হবে পৃথিবীকে। কারণ ব্যবহৃত পলিথিনের পরিত্যক্ত অংশ দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ও অবিকৃত অবস্থায় থেকে মাটি ও পানি দূষিত করে। পলিথিন জাতীয় পদার্থ মাটির উর্বরতা হ্রাস করে ও মাটির গুনাগুণ পরিবর্তন করে ফেলে।”সুত্র: বিবিসি

বৈশাখী নিউজজেপা