গ্যাস পাইপলাইন ঘিরে রুশ, জার্মান, মার্কিন ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব

জার্মান পত্রিকায় সম্প্রতি এক খবরে ছোট্ট একটা বাক্য ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক গ্যাস পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম-২ যারা নির্মাণ করছিলেন তাদের জন্য এটা ছিল ভূমিকম্পের মতো।

রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির ওপর বিষ দিয়ে হামলার ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিলেন জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেইকো মাস।

সে সময় তিনি মন্তব্য করেন, “আমার আশা নর্ড স্ট্রিম-২ নিয়ে আমাদের অবস্থান পরিবর্তনে রাশিয়া আমাদের বাধ্য করবে না।”

ইউরোপে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাবকে ঘিরে যে রাজনীতি চলছে তাতে এই নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এই রাজনীতিতে রাশিয়া, জার্মানি ছাড়াও রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চলীয় কয়েকটি দেশ।

নর্ড স্ট্রিম প্রকল্প কী?

নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্পটি চালু হবে ২০২১ সালে। এটি ২৪৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন। জার্মানি এখন চেষ্টা করছে কয়লা এবং পরমাণু জ্বালানি শক্তির ব্যবহার কমিয়ে আনতে। বাল্টিক সাগরের তলদেশ দিয়ে নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করে।

নর্ড স্ট্রিম-২ কিন্তু রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহের প্রথম প্রকল্প না। এর আগে নর্ড স্ট্রিম-১ নামে একটি পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে যেটি চালু আছে।

নর্ড স্ট্রিম-১ এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১১ সালে। দ্বিতীয় প্রকল্পটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে ২০২১ সালে। এটির দৈর্ঘ্য ২৪৬০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২,৩০০ কি.মি. লাইন ইতোমধ্যেই বসানো হয়ে গেছে।

রাশিয়া তার বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সম্পদ নানাভাবে বিদেশে রপ্তানি করতে চাইছে। তারা ইউক্রেইনের মাধ্যমে ইউরোপের কাছে গ্যাস বিক্রি করছে। সাইবেরিয়া থেকে তারা চীনে গ্যাসের পাইপলাইন বসাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে তারা তুরস্কের কাছে গ্যাস পৌঁছে দিচ্ছে।

পাইপলাইন রাজনীতি কেন প্রবল

সমালোচকরা বলছেন, নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্পের মাধ্যমে জার্মানি গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। মডার্ন ডিপ্লোম্যাসি সাময়িকীতে এক নিবন্ধে পিটার করযন উল্লেখ করছেন, অন্যদিকে বাল্টিক দেশগুলো এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছে এই কারণে যে এই পাইপলাইনকে রক্ষার জন্য রুশ নৌবাহিনী পুরো অঞ্চল জুড়ে টহল দিতে থাকবে।

রাশিয়া এমনকি তার সামরিক অভিযানের জন্য একে ব্যবহারের সুযোগ পাবে। এতে এসব দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।

মিসেস মের্কেলের মন যেভাবে কঠিন হলো

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাস, অ্যালেক্সি নাভালনির ওপর হামলার তদন্ত করার জন্য রুশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তা না হলে নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প বাতিল হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত করেন। নাভালনি বার্লিনের হাসপাতালে যখন কোমা থেকে বেরিয়ে আসছিলেন তার ঘণ্টা কয়েক আগে জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল জানিয়েছিলেন, ঐ পাইপলাইনের প্রতি সমর্থন তিনি পুনর্বিবেচনা করতে প্রস্তুত আছেন।

পরে তার একজন মুখপাত্র বলেন, “পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন মিসেস মের্কেল তার সাথে একমত।”

চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত জার্মান সরকারের অবস্থান ছিল নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্পের সাথে নাভালনির ওপর বিষপ্রয়োগের ঘটনাটিকে এক করে দেখা ঠিক হবে না। কিন্তু জার্মান নেতাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প সম্পর্কে মনোভাব কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

তবে মিসেস মের্কেল এবং তার রক্ষণশীল সরকার যে নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প নিয়ে আগে থেকেই খুব উৎসাহী ছিলেন এমন না। এই প্রকল্পটি তার আগের মধ্য-বামপন্থী চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রয়েডারের আমলে শুরু হয়।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে শ্রয়েডারের সম্পর্ক ছিল খুবই উষ্ণ। তিনি একবার রুশ প্রেসিডেন্টকে ‘আগাগোড়া খাঁটি গণতন্ত্রী’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

চাকরি ছাড়ার পর শ্রয়েডার রুশ জ্বালানি কোম্পানিগুলোতে একের পর এক লোভনীয় চাকরি পান, এবং তা নিয়ে জার্মানিতে মহা হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। তার একটি চাকরি ছিল নর্ড স্ট্রিম কোম্পানিতে। পুতিনের ধামাধরা হিসেবে শ্রয়েডারকে মনে করা হয়, এবং স্বাভাবিক কারণেই তিনি নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প নিয়ে খুব উৎসাহ দেখান।

কিন্তু গত কিছুদিন ধরে তিনি এই প্রকল্প নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি।

প্রকল্প কি বন্ধ হতে পারে?

নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প নিয়ে মের্কেল সরকার ইউরোপীয় দেশগুলোর তরফে থেকে বেশ চাপের মুখে পড়েছেন। তাদের যুক্তি: জ্বালানি নিশ্চয়তার জন্য রাশিয়ার মতো রাজনৈতিকভাবে নড়বড়ে একটি দেশের ওপর নির্ভর করা যায় না।

এই প্রকল্পের সবচেয়ে জোর বিরোধিতা এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে, এবং এই প্রকল্পের সাথে জড়িত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ট্রাম্প সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে।

এখন নাভালনির ঘটনাকে কেন্দ্র করে নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্প নিয়ে জার্মানিতে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের কনজারভেটিভ এবং গ্রিন পার্টি নেতারা প্রকল্পটি বাতিল করার দাবি তুলেছেন। কিন্তু এই প্রকল্পটি এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং ইতোমধ্যেই এর পেছনে প্রায় ১০০০ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। এই পর্যায়ে প্রকল্পটি বাতিল করার যুক্তি নিয়ে বিতর্ক চলছে।

এই প্রকল্পের সমর্থকরা বলছেন, এখন এই প্রকল্প বাতিল হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থিতিশীল একটি অঞ্চল সেই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দামও বেড়ে যাবে। তাদের আরও যুক্তি: প্রকল্প বাতিল হলে বিকল্প কোন উৎস থেকে জার্মানিকে গ্যাস আনতে হবে।

বার্লিন থেকে সাংবাদিক ডমিনিক ম্যাকগিনেস বলছেন, কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো অনেক জার্মান এই প্রকল্পকে সমর্থন করেন কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর বিরোধী। অনেক জার্মান তাকে খুব অপছন্দ করেন। এবং এই পাইপলাইনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অনর্গল কথাবার্তা এর প্রতি সমর্থন আরও বাড়াতে সাহায্য করেছে।

অনেক ভোটার মনে করেন তিনি এই প্রকল্প বাতিল করে তার জায়গায় আমেরিকান গ্যাস রপ্তানির সুযোগ খুঁজছেন। তাই মিসেস মের্কেলকে দেখাতে হবে যে তিনি কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার না করেই প্রকল্পটি বাতিল করছেন।

কিন্তু ফলাফল শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, নর্ড স্ট্রিম-২ প্রকল্পের দায়ভার জার্মানিকেই নিতে হবে এবং তার জন্য বিরাট অংকের আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হবে। আর সেকারণেই নর্ড স্ট্রিম-২ নিয়ে মার্কিন এবং ইউরোপীয় বিরোধিতা মিসেস মের্কেলের জন্য নতুন একটি সুবিধে তৈরি করে দিতে পারে।

তিনি যদি সত্যিই বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেন, তার জন্য সবচেয়ে সস্তা কৌশল হবে নীরবে প্রকল্প থেকে সরে আসা। মার্কিন এবং ইউ’র বিরোধিতা প্রকল্পটিকে একেবারে শেষ করে দেবে। আর তাতে সম্ভবত এর ব্যয়ভারও জার্মানির ওপর বর্তাবে না। সূত্র: বিবিসি বাংলা

বৈশাখী নিউজএপি