বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) অধীনে একটি প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ গঠিত তদন্ত কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুই সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির দু’জনই অভিযুক্তের ঘনিষ্ট। তারা অভিযুক্তের এলাকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু। এ নিয়ে বিএডিসিতে তোলপাড় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) অধীনে কুমিল্লা, চাঁদপুর, বি-বাড়িয়া জেলা সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত মিজানুর রহমান। তার বিরুদ্ধে এই প্রকল্প ঘিরে নানা আর্থিক অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
এ নিয়ে প্রাপ্ত অভিযোগের তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে ও মন্ত্রনালয়কে অবহিত করার জন্য বিএনডিসির চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রনালয়। গত ১৯ জুন কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো: জসিম উদ্দিন স্বাক্ষরিত আদেশে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৯ থেকে ২০২৪ অর্থ বছরে ৩৬৫.৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) অধীনে কুমিল্লা, চাঁদপুর, বি-বাড়িয়া জেলা সেচ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে খাল পুনঃখনন, ভূপরিস্থ সেচ নালা, ভূগর্ভস্থ সেচনালা নির্মাণ, রাবার ড্যাম নির্মাণ, হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম, ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ, সেচ অবকাঠামো নির্মাণ, শক্তিচালিত পাম্প স্থাপন, গভীর নলকূপ স্থাপন ও পুনর্বাসন, আর্টসিয়ান নলকূপ স্থাপন, সৌরশক্তিচালিত পাম্প ও টিউবওয়েল স্থাপন করার কথা রয়েছে।
প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের সময় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে প্রকল্প পরিচালক করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু বিধি বর্হিভুতভাবে এবং ডিপিপি অনুসরণ না করে বিএডিসি’র তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীকে প্রভাবিত করে একজন জুনিয়র নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়। প্রকল্পের প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হওয়ার পর গত বছরের ২৯ মে বিএডিসি’র ৮ জন সিনিয়র কর্মকর্তাদের ডিঙ্গিয়ে মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে পদোন্নতি দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক-উপপ্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অথচ ১৯৯০ এর প্রবিধানমালা ১৫/৪ ধারা মোতাবেক পঞ্চম গ্রেডের ওপরে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অবশ্যই সিনিয়রিটি দেখার বাধ্য বাধকতা রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মুলত বিএডিসিতে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ করার’ দারুন ক্ষমতা আছে মিজানুর রহমানের। ২০০৫ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে নিয়োগ পাওয়া মিজানুর রহমান তার কাজ কর্মে ভোল পাল্টান। এরপর থেকে নিজেকে প্রভাবশালীদের কাতারে নিয়ে যান। এজন্য তিনি তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে সখ্য গড়ে তোলেন। তাদের ‘চাহিদা পুরন’ করেন। এভাবেই তার চেয়ে সিনিয়র কর্মকর্তাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পদোন্নতি নিয়ে নেন। তার ওই পদোন্নতির পর ৬ প্রকৌশলী গত ১৩ জুন কৃষি সচিব, বিএডিসি চেয়ারম্যান, বিএডিসি সচিব ও বিএডিসির পরিচালকদের লিগ্যাল নোটিশ পাঠায় এবং পরবর্তীতে হাইকোর্টে রীট করেন।
যে প্রকল্পে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগে তদন্ত করা হচ্ছে সেই অভিযোগে বলা হয়, মিজানুর রহমান প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগদান করে সংস্থার নিয়ম কানুনের কোন তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছামত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। কুমিল্লা বিএডিসি কমপ্লেক্সের ভিতরের ৮ টি গাছ বিক্রির অনুমোদন নিয়ে কমপ্লেক্সের চার-পাঁচশত গাছ অবৈধ ভাবে কেটে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। বিএডিসি ইউনিট অফিস নির্মাণের জন্য বিএডিসি’র সার ও বীজ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত জায়গায় পুরাতন অবকাঠামো (চান্দিনা/মুরাদ নগর/ কসবা) কোনরূপ অকেজো ঘোষনা ছাড়াই অবৈধ ভবে বিক্রি করে দেন। ফলে সংস্থা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কোটি কোটি টাকা।
অভিযোগে আরো বলা হয়, প্রকল্পের আওতাধীন তিনটি জেলার ৯ টি কমপ্লেক্সের অফিস/আবাসিক ভবন মেরামতে ৫ বছরের জন্য এক কোটি টাকা’র সংস্থান রাখা হলেও তিনি ২ বছরেই শুধুমাত্র ১ টি কমপ্লেক্সের (কুমিল্লা) রিনোভেশনের নামে পঁচানব্বই লক্ষ টাকা খরচ করেছেন প্রকল্প পরিচালক মিজানুর। এ কাজের জন্য কোন দরপত্র আহ্বান না করে আরএফকিউ এর মাধ্যমে নিজেই উক্ত কাজ করেন যা আরপিআর-এর পরিপন্থি। এছাড়া ডিপিপিতে বিভিন্ন ক্রয়/ কাজের পদ্ধতি (ওটিএম/এলটিএম/আরএফকিউ) ইত্যাদি নির্দিষ্ট করা থাকলেও তিনি নিজের ইচ্ছামত ক্রয় পদ্ধতি অবলম্বন করে নিজে লাভবান হওয়াসহ নিজের পছন্দের লোককে কাজ পাইয়ে দিয়ে সরকারের অর্থের অপচয় করেছেন।
এসব অভিযোগ তদন্তে গত ১০ জুলাই বিএডিসির হিসাব নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেনকে আহ্বায়ক এবং উপ প্রধান প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেনকে সদস্য করে দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়েছে। বিএডিসির সচিব মো. আশরাফুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই কমিটিকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে ওই তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যিনি কমিটি গঠন করেছেন বিএডিসির সেই সচিব আশরাফুজ্জামানের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক এবং সখ্যতা রয়েছে মিজানুর রহমানের। কমিটিরতে তিনি যে দু’জন সদস্য রেখেছেন তা মিজানুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করেই রেখেছেন। এর মধ্যে মোয়াজ্জেম হোসেন তার একই এলাকার বন্ধু এবং সাজ্জাদ হোসেন তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। তারা একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন।
তদন্ত কমিটিতে ঘনিষ্ঠজন থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএডিসির চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদকে ফোন করা হলে তিনি একটি মিটিংয়ে রয়েছেন বলে ফোন কেটে দেন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত মিজানুর রহমান বলেন, আমার প্রতিটি কাজে কতৃপক্ষ সবসময় সন্তুষ্ট থাকে বলেই আমার প্রমোশন হয়েছিল। আসলে অনিয়মের কিছুই করিনি তবে আমার পদোন্নতি অনেকে সহ্য করতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে এসব অনিয়মের অভিযোগ আনেন। আর তদন্ত কমিটির মধ্যে যারা আছে তাদের সাথে এক সঙ্গে চাকরির সুবাদে সম্পর্ক রয়েছে। এর বাইরে কোন ঘনিষ্ঠতা নেই।
বিএডিসির বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীল সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে এমন দুর্নীতির অভিযোগ অনেকটা ওপেন সিক্রেট। তবুও ভয়ে কেউ কিছু বলে না। তাদের ভাষায়, মিজানুর রহমানের হাত অনেক লম্বা। তার সাথে শত্রুতা করতে যান না কেউ। এর আগেও তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিলো। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করেছিলো। কিন্তু কিভাবে যেন সবকিছু তিনি ‘ম্যানেজ’ করেন।
অভিযোগ রয়েছে, পিডি মিজানের সিন্ডিকেট ছাড়া অন্য কোন ঠিকাদার কাজ পায় না। এই ঠিকাদারী সিন্ডিকেট চক্রকে এককভাবে কোটি কোটি টাকার কাজ বন্টন করে তিনি নিজেও বিপুল অর্থের মালিক বনে গেছেন। তার মনোনীত ঠিকাদারকে গোপনে টেন্ডারের আইডি ও এস্টিমেট দর প্রদান করে দেন। অন্য প্রকল্পে যেখানে প্রতিসেট পিভিসি পাইপ পাঁচ লক্ষ টাকায় কিনেছে সেখানে একই সময়ে কুমিল্লা প্রকল্পে কিনেছে নয় লক্ষ টাকা দিয়ে। এভাবেই সরকারের কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে নিজের পকেট ভারী করেছেন পিডি মিজানুর রহমান। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন প্রকল্পের টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির চেয়ারম্যান বিএডিসির উপপ্রধান প্রকৌশলী মুহাম্মদ বদিউল আলম সরকার। দু’জনে মিলে ইজিপির মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেন। এজন্য নেন মোটা অঙ্কের টাকা।
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, বিএডিসিতে মিজানুর রহমানের একক আধিপত্য চলে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে রাজধানীর সিদ্বেশ্বরীসহ বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকটি বিলাশ বহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন মিজানুর রহমান। উত্তরা, নিকুঞ্জ ও পূর্বাচলে তার একাধিক প্লট রয়েছে। গ্রামের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় বাগান বাড়ি নির্মাণসহ বিপুল পরিমাণে জমি কিনেছেন। পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির পরিবারের সদস্যদের নামে বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।
সম্পাদকীয় : নাহার ম্যানশন (৩য় তলা), ১৫০ মতিঝিল ঢাকা।
নিউজ ও কমার্শিয়াল : মুন কমপ্লেক্স (৩য় তলা) ৫৯/১, পাটুয়াটুলি, ঢাকা।
ই-মেইল: boishakhinews24.net@gmail.com
হট লাইন: ০১৬৮৮৫০৫৩৫৬
https://www.boishakhinews24.net/