কৃষক বাঁচাতে উচ্চমূল্যে ধান, চাল, গম কিনবে সরকার

আপডেট: April 22, 2024 |

দেশে চলমান তীব্র দাবদাহের কারণে যেন আগুন ঝরছে ফসলের জমিতে। গাছেই পুড়ে যাচ্ছে ধান, গমসহ বিভিন্ন ফসল। কৃষকরা মাঠে বেশিক্ষণ থাকতে না পারায় জমিতে পানিও দিতে পারছেন না পরিমাণ মতো। যারা একটু বেশি সময় মাঠে থাকছেন গরমে সেসব কৃষকের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তারপরও খরার হাত থেকে জমির ফসল রক্ষায় সেচ দিতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন চাষিরা।

এদিকে তীব্র তাপপ্রবাহে গ্রামাঞ্চলের খাল-বিলও প্রায় শুকিয়ে গেছে। আর অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে গেছে। এসব কারণে পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে গোটা দেশের কৃষি। ফসল বাঁচাতে অন্যবারের তুলনায় তিনগুণ বেশি সেচ দিতে হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে দেশের কৃষি ও কৃষকের ত্রাহি অবস্থা।

এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষক বাঁচাতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উচ্চ দামে তাদের উৎপাদিত ফসল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এবার সাড়ে ১৭ লাখ টন ফসল কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে বোরো মৌসুমে ৫ লাখ টন ধান, ১১ লাখ টন সিদ্ধ চাল, এক লাখ টন আতপ চাল এবং ৫০ হাজার টন গম কিনবে সরকার। আগেরবারের চেয়ে কেজিপ্রতি ধানের দর দুই টাকা এবং চালে এক টাকা বাড়িয়ে এবারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে রবিবার (২১ এপ্রিল) খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভা শেষে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের এই লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম (টিটু) এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বেগম রোকেয়া সুলতানা এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে খাদ্যমন্ত্রী জানান, চলতি বোরো মৌসুমে ৫ লাখ টন ধান, ১১ লাখ টন সিদ্ধ চাল, এক লাখ টন আতপ চাল এবং ৫০ হাজার টন গম কিনবে সরকার। প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা, আতপ চাল ৪৪ টাকা এবং গম ৩৪ টাকা। আগের বছর ২০২৩ সালে সরকারের ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য যথাক্রমে ধান ৩০ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৪ টাকা এবং গম ৩৫ টাকা ছিল বলে জানান তিনি।

কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানান, তাপপ্রবাহ অনেক সময় কৃষকদের ভালো ফলন এনে দেয়। তবে এ মুহূর্তের তাপমাত্রার তীব্রতা কৃষকদের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষেতের ফসল বাঁচাতে অন্যবারের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি সেচ দিতে হচ্ছে, ফলে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। এমন আবহাওয়া দীর্ঘায়িত হলে চলতি মৌসুমের ধানসহ অন্যান্য ফল-ফসলের সামগ্রিক উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে অন্তত ৩০ শতাংশ।

দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলের চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকৃতির বিরূপ আচরণে তারা চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। গত বছর দীর্ঘতম খরার কবলে পড়ে তারা ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এক বছরের মাথায় আবার খরার কবলে পড়ে তারা মহাসংকটে। গভীর নলকূপের মাধ্যমে বোরো জমিতে সেচ দেয়ার চেষ্টা চললেও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে অনেক। আর ঘাস, পাট ও তিলের জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা তো সম্ভবই হচ্ছে না।

বেশ কয়েকজন চাষি জানান, তাদের অগভীর নলকূপ লেয়ার ফেল করছে। অনেক চাষি বিলে শ্যালো ইঞ্জিন লাগিয়ে পানি নেয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিলের অধিকাংশ স্থান শুকিয়ে গেছে। ফলে তারা মারাত্মক সেচ সংকটে পড়েছেন। অনেকে জানান, তারা পাট বুনতে পারছেন না। তিল বুনলেও বৃষ্টির অভাবে তা থেকে চারা গজায়নি। সেচ দিতে অতিরিক্ত খরচের মুখে পড়েছেন তারা। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া এলাকার চাষি তামিম বলেন- ধান, পাট, ভুট্টা লাগিয়েছি। ২-৩ বার সেচ দিয়েছি। কিন্তু এরপরও কাজ হচ্ছে না। আমার শ্যালো মেশিন লেয়ার ফেল করায় জমি থেকে তুলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। আমি কোনোভাবে খরচ পোষাতে পারছি না। তুহিন নামে আরেক চাষি বলেন, এ পর্যন্ত তিনবার সেচ দিয়েছি। একবার সেচ দিতে ১৫০০-২০০০ টাকা খরচ হয়। এতে করে আমরা পোষাতে পারছি না। তিনবার সেচ দেয়ার পর যে ফসল পাব তাতে উৎপাদন খরচ উঠবে না।

চাষি রাব্বানী জানান, তীব্র গরমের জন্য তারা জমিতে থাকতেই পারছেন না। মাঠে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্থির হয়ে কাজ ফেলে চলে যেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ২-৩ বার সেচ দেয়ার পরও জমি শুকিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বাড়লেও ফসল বেচার সময় নানা কথা ওঠে। এ ক্ষতি কিভাবে পোষাবেন তা নিয়ে ভাবনায় পড়েছেন তিনি।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন বৃষ্টি না থাকায় এবং হঠাৎ তাপমাত্রার তীব্রতার কারণে ফসলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু অনেকেই তা পারছেন না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনাবৃষ্টি সেই সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত পানি উত্তোলনে পানিশূন্যতার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে সেচ ও খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সাধারণ নলকূপে পানি মিলছে না। গভীর পাম্প বসিয়ে খাবার পানি তুলতে হচ্ছে। অনেক স্থানে তাতেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। অনাবৃষ্টির ফলে খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর শুকিয়ে গেছে। এতে কৃষির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

এমন অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের বাঁচাতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কষ্টের ফসলের উপযুক্ত দাম যাতে তারা পান সে জন্য উচ্চমূল্যে ধান, চাল, গম সংগ্রহ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাজারেও যাতে সঠিক দামে ফসল বিক্রি করতে পারেন সেদিকে লক্ষ্য রাখারও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ বলেন, কৃষিকে সহজ করতে সরকার যান্ত্রিকীকরণ বাড়াচ্ছে। দেশের কৃষক বাঁচার জন্য যা প্রয়োজন সেটাই সরকার করবে। ধান বিক্রিতে যেন কোনো সিন্ডিকেট তৈরি না হয় সেদিকে সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রকৃত কৃষকরাই যেন সঠিক দামে ধান বিক্রি করতে পারে সেদিকে কঠোরভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমরা আশা করি এ বছর ভালোভাবেই ফসল ঘরে তুলতে পারবে কৃষকরা। ধান বিক্রিতে যেন কোনো সিন্ডিকেট তৈরি না হয়, সেদিকে ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের লক্ষ্য রাখতে হবে।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর