সিসিক নির্বাচনে কে হচ্ছেন নৌকার মাঝি?

আপডেট: February 21, 2023 |

মিজান মোহাম্মদ: আসন্ন সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে সরকার দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী নিয়ে অনিশ্চতা কাটছে না বরং পর পর ঘোষণা বিষ্ফোরণে দলীয় প্রার্থী নিয়ে ধূম্রজাল আরো বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর প্রার্থীতা ঘোষণা ও অব্যাহত প্রচারণার মধ্যখানে এডভোকেট মিছবাহ উদ্দিন সিরাজের প্রার্থীতা ঘোষণা করেন। এর ঠিক পরের দিন মেয়র পদে প্রার্থীতা ঘোষনা করলেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন।

কামরান বিহীন নগরে নৌকার কান্ডারি কে হবেন? কে হবেন জনতার কামরান? কে হবেন কামরানের যোগ্য উত্তরসূরী? পর্যন্ত কে হচ্ছেন নৌকার মাঝি? নগরীর অলি গলিতে এখন এনিয়ে চলছে চুলছেড়া বিশ্লেষণ।

পূর্ব থেকে সিসিক নির্বাচনে আলোচনায় না থাকা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ২২ জানুয়ারি দেশে আসেন। ওই দিন সকালে তাকে বরণে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দলীয় নেতাকর্মীদের ঢল নামে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল ও সিলেট-৩ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিবও। এছাড়াও আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাকে বরণ করতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। ওসমানী বিমানবন্দর থেকে মোটর শোভাযাত্রা করে তাকে নিয়ে আসা হয় নগরীতে। দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং হযরত শাহজালাল (র.) মাজার জিয়ারত করেন আনোয়ারুজ্জান চৌধুরী। এতেই তার মনোনয়নপ্রাপ্তির বিষয়টি অনেকটাই খোলাসা হয়ে যায়।

অন্যদিকে, এডভোকেট মিছবাহ উদ্দিন সিরাজ গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির বার্ষিক বাজেট সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে মেয়র পদে প্রার্থীতা ঘোষণা দেন। মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ এর আগে দীর্ঘদিন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা ১১ বছর সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলির (পিপি) দায়িত্ব পালন করেন।

আইনজীবী সমিতির সভায় মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, আমি আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করতে চাই। জাতির পিতার হত্যাকারী খন্দকার মোশতাক আহমেদ সিলেটে এলে তাকে গণপিটুনি দেওয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। এ কারণে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ১৭ মাস জেল খেটেছি। দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছি। মেয়র নির্বাচনে অংশ নিতে অনেক দিন ধরে কাজ করছি। তবে যেহেতু আমি দল করি, তাই দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

এর ঠিক পরের দিন ১৭ ফেব্রুয়ারি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন সিলেট সিটির নবগঠিত ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের টুকেরগাঁও জামে মসজিদে নামাজ শেষে নিজেকে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ঘোষনা করেন।। এ লক্ষ্যে জুমার নামাজ শেষে জাকির হোসেন স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কুশলও বিনিময় করেন এবং বলেন- ‘ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে চাই। একটি স্মার্ট মহানগর গড়তে চাই। স্মার্ট মহানগরের সব সুযোগ-সুবিধা নগরবাসীর জন্য সুনিশ্চিত করতে চাই।’

এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক নজমুল ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক সেলিম আহমদ, কার্যনির্বাহী সদস্য আবদুল আজিম ও খলিল আহমদ, টুকেরবাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মুকিত প্রমুখ।

জানা যায়, চলতি বছরের মাঝামাঝি পঞ্চমবারের মতো সিলেট সিটি নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এবারের সিসিক নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই স্থানীয় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে বাড়ছে উত্তাপ। ক্রমান্বয়ে নেতৃবৃন্দ নিজেদের প্রার্থীতা ঘোষণা করতে শুরু করেছেন। এর পর থেকেই সিলেটের আওয়ামী পরিবারে তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়। পরপর দুইদিনে দুই হেভিওয়েট প্রার্থীতা ঘোষণা ও অব্যাহত প্রচারণার সিসিক নির্বাচনে দলীয় মেয়র প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী পরিবারে ধূম্রজাল আরও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ধারণা করা হচ্ছে অচিরেই আরো কয়েকজন নেতা নিজেদেরকে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ঘোষনা করে প্রকাশ্যে মাঠে আসবেন। ফলে প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নির্বাচনী তৎপরতা চরমভাবে ঘোলাটে হয়ে পড়ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সিলেট-২ আসন নিয়ে নিয়ে আলোচনায় ছিলেন। উক্ত আসনে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী বলয়ের বাহিরে তাঁর একটা নিজস্ব বলয় রয়েছে। তাই উক্ত আসনের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও তাকে ভবিষ্যৎ সংসদ সদস্য প্রার্থী মনে করতেন। কিন্তু হঠাৎ করে সিটি নির্বাচনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীদের মনোনয়ন দৌঁড়ে হারিয়ে তিনি মনোনয়ন পেলে শেখ হাসিনাকে কতটুকু প্রতিদান দিতে পারবেন তা ভাবনার বিষয়। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে অন্যান্য প্রার্থীরা তাকে সহযোগিতা করলে বিজয় চমক দেখানো অসম্ভব নয়।

এছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ গত সিসিক নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু দল থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত আর নির্বাচন করা হয়নি। কিন্তু তিনি যেহেতু দীর্ঘদিন থেকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত সেহেতু তারও নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলে তিনিও কামরানের বিকল্প হতে পারেন।

অন্যদিকে, সিসিকের প্রথম মেয়র প্রয়াত বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান পুত্র মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আরমান আহমদ শিপলু দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। পিতা প্রয়াত কামরান ও মা আসমা কামরানের বিপুল সংখ্যক নিজস্ব কর্মী সমর্থকের পাশাপাশি তারও নিজস্ব কর্মী সমর্থক রয়েছে। তাই নিজের ইমেজের পাশাপাশি প্রয়াত পিতার ইমেজকে কাজে লাগিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলে ও আওয়ামী পরিবারের সন্তান হিসেবে নির্বাচনে ইতিহাস গড়ে হতে পারেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সর্বকনিষ্ঠ মেয়র।

এছাড়াও চার চার বারের সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ দীর্ঘদিন থেকে নিজেকে ভবিষ্যৎ মেয়র হিসেবে তৈরি করে আসছেন। চার বার কাউন্সিলর পদে বিজয়, সিলেট উল্লেখযোগ্য চার গ্রুপের এক গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করা, শহর ও শহরতলীতে কর্মীদের মধ্যে সমন্বয় করে ইতিমধ্যে তিনি নিজের যোগ্যতার জানান দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাই তিনি যদি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান তাহলে উল্লেখিত প্রার্থীদের তিনিও দলকে বিজয় উপহার দিতে পারবেন। কারণ তার ভোট ব্যাংকে ইতিমধ্যেই কিছু ভোট জমা আছে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যাঁরা দেশে থেকে বছরের পর বছর দলের জন্য কাজ করে গেলেন, বিপদে-আপদে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করলেন, দেশ ও দলের বিপদের দুঃসময়ে বুক পেতে নেতৃত্ব দিলেন তাদের মধ্যে যে কাউকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া প্রয়োজন, নইলে সেটা হবে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।’

দলটির তৃণমূলের নেতাদের মতে, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান পুত্র মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আরমান আহমদ শিপলু বা চার বারের সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া উচিত।

জানা যায়, ২০০২ সালে পৌরসভা থেকে সিলেট সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত চারবার নির্বাচন হয়েছে। প্রথম দুই বার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান জয়ী হন। পরবর্তী দুই মেয়াদে বিএনপি প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র পদে নির্বাচিত হন।

২০২০ সালের ১৫ জুন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান মারা গেলে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে তৎপর হন আওয়ামীলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিছবাহ উদ্দিন সিরাজ, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক কামরানপুত্র ডা. আরমান আহমদ শিপলু, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ, যুগ্ম সম্পাদক এ টি এম এ হাসান, সদস্য প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী। এখন নতুন করে মনোনয়ন দৌড়ে যুক্ত হলেন প্রবাসী আওয়ামীলীগ নেতা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর