টিকা ছাড়া কভিড-১৯ প্রতিহত করার কার্যকরি ওষুধগুলো কী কী হতে পারে?

আপডেট: May 26, 2020 |

বিশ্বজুড়ে প্রলয় সৃষ্টি করেছে আণুবীক্ষণিক জীব নভেল করোনাভাইরাস। গুঁড়িয়ে দিচ্ছে মানবজাতির সভ্যতা ও বিজ্ঞানের দম্ভ। কোন ওষুধ নেই, প্রতিষেধক নেই। শুধুই মৃত্যুর অপেক্ষা। এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ। আক্রান্ত ৫৬ লাখের বেশি। একটা প্রতিষেধক এলে তবেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে দুনিয়া। চেষ্টা চলছে বিভিন্ন দেশে। কোন কোন দেশে কিছুটা হলেও সাফল্য দেখা যাচ্ছে। যদিও কেউই এখনো চূড়ান্ত কিছু রিপোর্ট দেয়নি। টিকা আবিষ্কার ছাড়া কিভাবে চলবে কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা? কেমন হতে পারে কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি?

ব্রিটেনের ব্র্যাডফোর্ড রয়াল ইনফারমারি-র (বিআরআই) চিকিৎসক ডা. জন রাইট কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় কিছু সুনির্দিষ্ট পরীক্ষার কথা বর্ণনা করেছেন যেখানে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, তিনটি আলাদা ধরণের ওষুধের একটি সংমিশ্রণ রোগটির চিকিৎসায় কার্যকর হতে পারে।

ছবি- অধ্যাপক জন রাইট।

তিনি তার অভিজ্ঞতার বর্ণনায় বলেন, বিআরআই-তে আমরা কভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য মোট আটটি পরীক্ষা পরিচালনা করছি। আন্তর্জাতিক বিশাল পদক্ষেপের একটি অংশ আমরা। মনে হচ্ছে যে বিশ্ব বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ মনোযোগ একটি একক লেজার রশ্মির মাধ্যমে একটি অদৃশ্য প্রায় ভাইরাসের উপর দেয়া হয়েছে।

করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় বিশ্বে যতগুলো পরীক্ষা চলছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি হচ্ছে ব্রিটেনে। পুরো দেশের প্রায় ১০ হাজার রোগী এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে যেখানে তাদের উপর কোন না কোন চিকিৎসা পদ্ধতি বা ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে।

গত সপ্তাহে বিআরআইতে প্রথম একজন রোগীকে নির্বাচন করা হয়েছে তার উপর ছোট একটি পরীক্ষা চালানোর জন্য। অ্যাস্ট্রাজেনেকা নামে একটি কম্পানির তৈরি একটি ওষুধ নিরাপদ ও কার্যকর কি না সেটি জানতে তার উপর পরীক্ষা করা হবে। একে বলা হয় অ্যাকর্ড ট্রায়াল-এটি হচ্ছে বড় ধরণের পরীক্ষার জন্য ওষুধ বাছাইয়ের জন্য ছোট পরীক্ষা বিশেষ।

আশা করা হচ্ছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি এই ওষুধটি যার এখনো কোন নাম দেয়া হয়নি, সেটা হয়তো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কিছু জটিল প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়ক হবে। আক্রান্ত খুব কম সংখ্যক রোগীর মধ্যে এ ধরণের উপসর্গ দেখা দেয়। এগুলো হচ্ছে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, শিরা ও ধমনী এবং কিডনির কার্যক্ষমতা বন্ধ করে দেয়া। এই উপসর্গগুলোর নাম দেয়া হয়েছে “সাইটোকিন স্টর্ম”-সাইটোকিন হচ্ছে কোষের এমন ক্ষুদ্র অংশ যা শরীরে সংক্রমণের উপস্থিতি জানান দেয়। নতুন এই ওষুধ আইএল-৩৩(ইন্টারলিউকিন-৩৩) নামে একটি সাইটোকিনকে অচল করে দেয়।

মার্ক উইন্টারবোর্ন নামে একজন স্বেচ্ছাসেবী যিনি আইএল-ব্লকার হিসেবে পরিচিতি এই ওষুধটি নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি এরই মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছে গেছেন।

তার মধ্যে যে উপসর্গগুলো রয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে যে সেগুলো হয়তো তার পিত্ত-থলিতে পাথরের কারণে হয়েছে। তবে তার মধ্যে এই উপসর্গগুলো শুধু তার মধ্যে কভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পরই দেখা দিয়েছে। কভিড-১৯ হচ্ছে এমন একটি রোগ যারা নানা ধরণের উপসর্গ রয়েছে- কিন্তু এমন উপসর্গ খুব স্বাভাবিক নয়।

মার্ক বলেন, তিনি নিজে থেকেই স্বেচ্ছাসেবক হতে রাজি হয়েছেন। আমার মনে হয় যে, কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক আসতে এখনো বছর খানেক সময় লাগবে। আর তাই চিকিৎসার সন্ধানে চালানো পরীক্ষাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চিকিৎসকরা এমন একটি সময়ের অপেক্ষায় রয়েছেন- যা হয়তো খুব বেশি দূরেও নয়- যখন মৃদু উপসর্গ নিয়ে কেউ আসলে তাকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো হবে, নমুনা নেয়া হবে, শীঘ্রই ফল পাবেন এবং তাকে কয়েকটি ওষুধের সমন্বয়ে একটি প্রেসক্রিপশন দেয়া হবে যেটি তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করবে।

এসব ওষুধের মধ্যে থাকতে পারে একটি অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে রক্ষা করার মতো একটি ওষুধ এবং একটি ওষুধ যেটা প্রদাহ কমাবে। অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ দুই ধরণের হতে পারে। যার একটি করোনাভাইরাসের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটানো ঠেকাবে এবং অন্যটি শরীরের অন্যান্য স্থানে এর ছড়িয়ে পড়া ঠেকাবে।

রোগ প্রতিরোধ শক্তিশালী করার ওষুধগুলো সাইটোনিক স্টর্ম বা ভাইরাসের প্রতি কোষের অতি-প্রতিক্রিয়াকে রোধ করবে। যদি পরীক্ষায় থাকা আইএল-৩৩ কার্যকর হয় তাহলে এটি একটি ভাল ওষুধ হবে। প্রদাহ কমানোর ওষুধের মধ্যে রয়েছে স্টেরয়েড যেমন ডেক্সামেথাসন।

অধ্যাপক জন রাইট একজন চিকিৎসক এবং একজন মহামারি বিশেষজ্ঞ। তিনি ব্র্যাডফোর্ড ইন্সটিটিউট ফর হেলথ রিসার্চ প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি কলেরা, এইচআইভি এবং আফ্রিকা এলাকার মহামারি ইবোলা নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি বিবিসি নিউজের জন্যই তার ডায়েরিটি লিখছেন এবং বিবিসি রেডিওর জন্য হাসপাতাল থেকেই রেকর্ড করছেন।

তার মতে, এখনো পর্যন্ত মনে হচ্ছে যে, কভিড-১৯ এর চিকিৎসায় এখনো একক কোন ওষুধ কার্যকর নয়। বরং বেশ কয়েকটি ওষুধের একটি সমন্বিত ডোজ দরকার হবে। যেমন আগে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় বেশ কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিকের সমন্বয়, কিংবা এইচআইভি রোগের ক্ষেত্রে কয়েকটি অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ একসাথে ব্যবহার করা হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে এই রোগের ক্ষেত্রেও এ ধরণের কিছুই কাজ করবে।

বিআরআই এর বক্ষব্যাধী বিষয়ক কনসালটেন্ট দিনেশ সারালয়া বেশ আশাবাদী, কারণ তিনি মনে করছেন যে গ্রীষ্মকাল শেষ হওয়ার আগে আগেই হয়তো এ ধরণের কয়েকটি ওষুধের একটি সমন্বয় আসবে।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আমরা অন্তত দুটি বা তিনটি ওষুধ খুঁজে পাবো যেগুলো সেবন করলে হয়তো রোগীকে আর হাসপাতালেই আসতে হবে না। আপনি পরীক্ষা কেন্দ্রে যাবেন আর পরীক্ষার পর আপনাকে কয়েকটি ওষুধ দেয়া হবে। বর্তমানে আপনি কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার পর আপনাকে আইসোলেশনে যেতে হয়, তারপর অবস্থা আরো খারাপ হয়, জ্বর আসে, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, তারপর আপনি হাসপাতালে আসেন। কিন্তু মানুষকে আসলে আরো আগে প্রাথমিক অবস্থাতেই ওষুধ দিতে হবে।’

এই প্রতিষ্ঠানের চার কনসালটেন্টদের আরেক জন অন্য আরেকটি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন- এটি হচ্ছে অ্যান্টিবডি দানের একটি পরীক্ষা।

ডেবি হর্নার মহামারি শুরুর দিকে কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন এবং খুব তাড়াতাড়ি সেরেও ওঠেন। দুই সপ্তাহ আগে যখন রক্তের প্লাজমা দান করার খবর আসে তখন তিনি সেটি শুনেই রাজি হয়ে যান। গবেষকরা দেখার চেষ্টা করছেন যে, কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর সেরে ওঠা ব্যক্তির রক্তের প্লাজমা অন্য রোগীদের সেরে উঠতে সাহায্য করে কি না। এটিও সেরে ওঠা পরীক্ষার একটি অংশ।

ছবি- ডেবি হর্নার।

এটা এখন প্রমাণিত যে, যাদের শরীরে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবডি রয়েছে তারা হচ্ছে পুরুষ, ৩৫ বছরের বেশি বয়সী এবং যাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সেবা নেয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। এনএইচএস ব্লাড এন্ড ট্রান্সপ্লান্ট এমন সবার কাছ থেকে প্লাজমা নিতে আগ্রহী যারা কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছেন, হয় তারা পুরুষ কিংবা ৩৫ বছরের বেশি বয়সী এবং যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

ডেবির মৃদু উপসর্গ ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে যে তার প্লাজমায় হয়তো পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যান্টিবডি নেই যার খোঁজ করছেন এই চিকিৎসকরা। তবে পরীক্ষার ফল এখনো আসেনি। যদি তার প্লাজমা চাওয়া হয় তাহলে সে খুশির সাথেই দান করবে বলে জানায়।

প্লাজমা দান সম্পর্কে ডেবি হর্নার বলেন, ‘সাধারণ রক্ত নেয়ার চেয়ে এটি একটু আলাদা, তারা রক্তের একটা অংশ নেয় মাত্র, শুধু প্লাজমা অংশ- পরে তারা আপনার রক্তের অন্য অংশ যেমন রক্তকণিকাসহ অন্য উপাদান যেগুলো অপ্রয়োজনীয় সেগুলো ফিরিয়ে দেয়। এটা শরীর থেকে একটু বেশি পরিমাণ পানি চলে যাওয়ার মতো। কয়েক কাপ চা খেলেই এই ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।’

ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মাইক মারফি বলেন, প্লাজমা পরিবর্তনটা ভাল ভাবে বোঝার জন্য এটা খুবই ভাল একটি সুযোগ। ২০০০ সালের দিকে প্লাজমা সংগ্রহ শুরু হয় এটা দেখতে যে প্লাজমা ইবোলা এবং ফ্লু আক্রান্তদের চিকিৎসায় কাজ করে কি না।

তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে স্বাস্থ্যবান অনেক দাতা রয়েছে যারা সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন, এখনই দান করতে সক্ষম, সংক্রমণের চূড়া বা পিক পার হয়ে গেছে, তাই প্লাজমার সুবিধা নিয়ে পরীক্ষা করার মতো তেমন কিছু আর নেই। কভিড-১৯ অবশ্যই আলাদা ধরণের একটি মহামারি।’সূত্র- বিবিসি বাংলা।

বৈশাখী নিউজইডি

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর