তরুণী পাচারকারী আজমদের কঠোর শাস্তি চাই
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আদম পাচারের সঙ্গে নারী পাচারের ঘটনা প্রায়শঃ শোনা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের অল্প বয়সী তরুণীদের উচ্চ বেতনে বাসা-বাড়িতে কাজ দেওয়াসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়।
যেখানে একটি শক্তিশালী মহল দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করে যৌনকর্মে লিপ্ত করতে বাধ্য করছে এমন অবলা নারীদের অসহায়ত্বের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে।
গত ৮ বছরে হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি তরুণীদের আরব আমিরাতসহ দুবাইয়ে পাচার করা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গিয়েছে । এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক একটি চক্র জড়িত। প্রধান আসামি আজমসহ তার দুই সহযোগীকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি গ্রেফতার করেছে।
গ্রেফতার হওয়া অন্য দুইজন হল ময়না ও মো. আলামিন হোসেন ওরফে ডায়মন্ড। সিআইডির সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম প্রধান ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ এমন তথ্য প্রকাশ করেছেন।
ইমতিয়াজ জানিয়েছেন- দুবাইয়ে এ চক্রের গডফাদার আজমের বিলাসবহুল হোটেল রয়েছে। আজম ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্রান্ড ও হোটেল সিটি টায়ারের অন্যতম মালিক আজম।
এরমধ্যে তিনটি চার তারকা এবং একটি তিন তারকা বিশিষ্ট হোটেল।
আজম বাংলাদেশে তার নিয়োগকৃত দালালের মাধ্যমে তরুণীদের উচ্চ বেতনে কাজ দেয়ার কথা বলে প্রলুব্ধ করতেন। দেশে তার সহযোগী দালালরা প্রতিটি তরুণীর জন্য ১০ হাজার করে টাকা পেত। অন্যদিকে ভিকটিমদের অগ্রিম বেতন দেয়ার কথা বলে প্রলুব্ধ করা হতো।
দুবাই পর্যন্ত ভিকটিমদের যাওয়া, থাকা খাওয়ার সব খরচ দালালচক্র পরিশোধ করতো। অগ্রিম বেতন হিসেবে ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতো আজম।
এ ছাড়া দালালরা তরুণীদের প্রলুব্ধ করে নির্ধারিত দুটি বিদেশি এয়ারলাইন্স এজেন্সির মাধ্যমে দুবাই পাঠাত। সেখানে যাওয়ার পর তাদের প্রথমে ছোটখাটো কাজ দেয়া হতো। এরপর জোরপূর্বক ড্যান্স ক্লাবে নাচতে বাধ্য করা হতো। আটকে রাখা হতো, খাবার দেয়া হতো না, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। বৈদ্যুতিক শক পর্যন্ত দেয়া হতো যৌনকর্মে লিপ্ত হতে।
এসব গুরুতর অভিযোগের পর দুবাই সরকার দূতাবাসকে জানিয়ে চক্রের গডফাদার আজমের পাসপোর্ট জব্দ করে তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে আসার পর আজম আত্মগোপনে যায়। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে বারবার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে।
এক পর্যায়ে পাসপোর্ট করে পার্শ্ববর্তী দেশে পালানোর চেষ্টাও করেন। কিন্তু পালানোর আগেই দুই সহযোগীসহ সিআইডি তাকে আটক করে। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা আছে দেশের বিভিন্ন থানায়। এর মধ্যে ছয়টি হত্যা মামলা রয়েছে। তাদের গ্রেফতারের পর সিআইডি বাদী হয়ে গত ২ জুলাই রাজধানীর লালবাগ থানায় মামলা করেছে, যা বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে।
দুবাই ড্যান্স ক্লাবের আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারীচক্রের মূল হোতা আজম খানকে গ্রেফতারের পর জানা গেল তার অপকর্মের এসব কাহিনী । প্রতি বছরই আকাশ, বিমান বা কখনো নৌ পথে বিদেশে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামের সহজ সরল তরুণীদের দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে পাঠায় দালালরা। এটা জানা যায় বিদেশে যাওয়া পর, তাদের তখন যৌন কর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করা হয়।
প্রথমে বিষয়টি পরিবার জেনে ফেলে। এরপর দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশ হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরে আসে।
সরকার অনেক সময় কিছু কিছু তরুণীকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। অনেক সময় অপরাধীদের গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে তা অজানা থেকে যায়।
আমাদের দেশে অনেক যৌনকর্মী রয়েছে। যাদের সম্পর্কে জানতে গেলে প্রথমেই তাদের উত্তর হয়ে থাকে কোন না কোন প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েই তাদের আজ এই পরিচয়। তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কোন আজম হয়তো তাদের বাধ্য করেছে এ পথ বেঁছে নিতে।
এ প্রসঙ্গে আমাদের সরল বক্তব্য হল- নারীদের মান-ইজ্জত তাদের নিজেদের রক্ষা করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারেরও গুরু দায়িত্ব রয়েছে। কঠোর আইন প্রয়োগ করে নারীদের মান-ইজ্জত রক্ষায়। যারা পাচারের পথে নেমেছে তাদের সঠিক পথে ফিরে আসতে হবে তাদের নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে।
বিভিন্ন ভাবে পাচার হওয়া নারীদের দেশে ফেরত আনার পর যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে পুনর্বাসন কেন্দ্রও তৈরি করতে হবে বিশেষ ভাবে। এ ব্যাপারে আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিও অত্যন্ত প্রয়োজন।
আমাদের জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে।
আমরা মনে করি পাচার থেকে নারীদের রক্ষা করতে ধর্মীয় অনুশাসনের ওপর গুরুত্ব আরোপ বেশি জরুরী। এর ওপর সরকার থেকে নির্দেশনা এলে বিপথগামীরা আইন মানতে বাধ্য হবে।
রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন মানার ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ নিলে নারীদের বিদেশে পাচার বা যৌন ব্যবসা বন্ধ হতে পারে। এখন পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে নারী পাচার।
কারণ বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত ধর্মভীরু। একই সঙ্গে আমাদের বক্তব্য হল আজমের মতো অনেক পাপিষ্ঠ আজম বাংলাদেশে আছে। তাদের খুজে বের করে শাস্তি দিতে হবে।
এ অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে কেউ আর অপরাধ করতে সাহস পাবে না। সরকার যদি মনে করে প্রচলিত আইন যথেষ্ট নয়, সে ক্ষেত্রে নতুন করে কঠোর আইন করা যেতে পারে। নতুন আইন করলে দেশের মানুষ সরকারকে সাধুবাদ জানাবে।
মোল্লা আতাউর রহমান মিন্টু
(বিশিষ্ট সাংবাদিক, গবেষক)
বৈশাখী নিউজ/ এপি