শেখ ফজলুল হক মণির ৮১তম জন্মদিন আজ

আপডেট: December 4, 2020 |

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে লেখা মূল্যবান চারটি খাতা প্রসঙ্গে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ভূমিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার আরেক ফুফাতো ভাই বাংলার বাণী সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সে এ খাতাগুলো পেয়েছিল।

সম্ভবত আব্বা শেখ মণিকে টাইপ করতে দিয়েছিলেন, আত্মজীবনী ছাপাবেন এ চিন্তা করে।’ ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বিকেলে শুনলাম মণিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, শরীর খারাপ করেছে।

দুই দিন পরে আইন পরীক্ষা দিবে। একটু চিন্তাযুক্ত হলাম।’ মে মাসে লিখেছেন, ‘মণি জেল হাসপাতাল থেকেই ল’ পরীক্ষা দিতেছে, ভালোই দিয়েছে খবর পেলাম।’ ৪৭তম জন্মবার্ষিকীতে পাওয়া কেক নিয়ে লিখেছেন, ‘কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেট থেকে।

ওর সঙ্গে দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।’ বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবও শেখ মণিকে অনেক স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলগেটে মণির সঙ্গে দেখা করতে’ (সূত্র : কারাগারের রোজনামচা)।

একাধারে রাজনীতিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, তাত্ত্বিক, লেখক ও দার্শনিক শেখ ফজলুল হক মণির বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিটি স্তরেই রয়েছে মুজিবাদর্শের আলোকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার ইতিবৃত্ত এবং কালোত্তীর্ণ মুক্তি-দর্শনের পথ। তিনি বঙ্গবন্ধুকে অত্যধিক ভালোবাসতেন।

মুজিববাদের তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি এবং রাজনৈতিক-সামাজিক মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। ১৯৭২ সালে ‘বাংলার বাণী’তে ‘মুজিববাদ : দর্শন ও বাস্তবে’ শিরোনামে তার ধারাবাহিক কলাম যেমন মুজিববাদী তত্ত্ব বিনির্মাণের ঐতিহাসিক রচনা, তেমনি তার ‘দুরবিনে দূরদর্শী’ গ্রন্থ এবং অন্যান্য সম্পাদনাও সে সময়ের রাজনীতি বিশ্লেষণের গুরুত্বপূর্ণ দলিল।

‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ তার ঐতিহাসিক সম্পাদনা। তার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘অবাঞ্ছিতা’ টেলিফিল্ম। তার গল্প সংকলন ‘বৃত্ত’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। শেখ মণির উদ্যোগে ও সম্পাদনায় ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক বাংলার বাণী, ১৯৭৩ সালে সাপ্তাহিক সিনেমা এবং ১৯৭৪ সালে ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস প্রকাশিত হয়।

শেখ মণি মাত্র ২৩ বছর বয়সে (১৯৬২-৬৩) পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন আন্দোলন এবং ১৯৬৪ সালে গভর্নর মোনেম খানের কাছ থেকে সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতিসহ মুজিববাদী আন্দোলনের কারণে তিনি বারবার কারাবরণ করেছেন।

১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আগে স্লোগান ছিল ছয় দফা, এখন চার স্তম্ভ। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে এ চার স্তম্ভের (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) ভিত্তি বলা হয়।

‘ছেষট্টির সাত জুন : প্রস্তুতি পর্ব’ নিবন্ধে শেখ মণি লিখেছেন, ‘মওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ আরও কিছু বাম সংগঠনের আপত্তি থাকায় ছয় দফার পক্ষে জনসমর্থন আদায় এবং হরতাল সফল করা অত্যন্ত কঠিন। তার ওপর শেখ মুজিব জেলে।’ ‘…জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছেন হরতালের প্রস্তুতি কতদূর কী হল সেটা সম্পর্কে। গভীর রাতে পেছনের দেয়াল টপকিয়ে ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গেলাম। মামিকে বিস্তারিতভাবে সবকিছু জানিয়ে বললাম রাতের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পৌঁছে দেয়ার জন্য। হরতাল হবেই।’

ছয় দফা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকার কারণে শেখ মণির বিরুদ্ধে হুলিয়া জারিসহ আটটি মামলা করা হয়েছিল। ফলে ১৯৬৮ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হলেও শেখ মণি মুক্তি পাননি। কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ছয় দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে। … আমার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সবার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।’

ছয় দফাসহ বাঙালির অধিকার বাস্তবায়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তিনি ১৯৭০-এর নির্বাচনী ইশতেহার ও কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন মুজিববাহিনী। যে বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরে স্বাধীনতার সুফল নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। মুজিব বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার হিসেবে শেখ মণি যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

স্বাধীনতার পর মাঠে-ময়দানে রাজনীতি চর্চার চেয়ে মুজিববাদী দর্শন প্রতিষ্ঠায় বেশি মনোযোগী হয়েছিলেন শেখ মণি। কথিত আছে, মুজিববাদী দর্শনে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তিনি স্বাধীনতার সময় ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ‘শিক্ষকতার প্রস্তাব’ কিংবা স্বাধীনতার পর মন্ত্রিত্বের পদ নেননি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মুজিব আদর্শ বাস্তবায়নে ‘সরকার ও জনগণের করণীয়’ এবং ‘সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সংস্কার’ সম্পর্কিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার কারণে শেখ মণি ক্ষমতাবান অনেকের বিরাগভাজনও হয়েছেন। ৬ অক্টোবর ১৯৭২ সালে এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আমরা ধনতন্ত্রে ফিরে যেতে চাই না, আমরা চাই মুজিববাদী বাংলাদেশ। তাই মুজিববাদী বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনাকে কার্যকর করার জন্য নতুন আইনের শাসন দরকার, পুরনো আইনের ব্যাধির সংক্রমণ নয়। বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতার চাহিদা সেটাই।’

স্বভূমিতে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৈশ্বিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক শেখ মণি ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে একটি নিবন্ধে বলেছিলেন, ‘আমরা কেবল শুরু করেছি। আবর্জনা সাফ করে আমাদের যাত্রাপথ তৈরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই পথপ্রদর্শক-কাণ্ডারি।

খোদা না করেন, তাকে যদি আমরা হারাই, তাহলে বাংলার এ সাড়ে সাত কোটি দুঃখী মানুষের ভাগ্যে কী আছে! সুতরাং জাতীয় স্বার্থেই তার জীবনের জন্য যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার চেয়ে শতগুণ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল।’ ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পেরেছিল, শেখ মণি জীবিত থাকলে মুজিব আদর্শবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্র বাংলার মাটিতে বাস্তবায়িত হবে না। এ কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার আগে খুনিচক্র শেখ মণি এবং তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী সামসুন্নেসা আরজু মণিকে হত্যা করেছিল।

অকালে অন্যায়ভাবে ঘাতকরা মাত্র ৩৬ বছর বয়সে শেখ মণির তাজা প্রাণ কেড়ে নিলেও তার উদ্যোগ-স্বপ্ন, আদর্শ, পরিশ্রম, সংগ্রাম, নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা, সাহস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ বাঙালিমুক্তির মর্যাদা ও মুজিবীয় আদর্শের মৌলিকতার প্রতীক। মুজিবাদর্শে যুবসমাজকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন বাংলার প্রথম যুব সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।

৪ ডিসেম্বর ১৯৩৯ সালে টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণকারী শেখ ফজলুল হক মণির ৮১তম জন্মবর্ষে বৈশাখী নিউজ টোয়েন্টিফোর .নেটের পক্ষ থেকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

 

 

বৈশাখী নিউজ/ জেপা

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর