এ অঞ্চলকে দারিদ্র্যমুক্ত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস অব্যাহত রাখব : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপনের এই শুভ মুহূর্তে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিশ্ববাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সে সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার করে এ অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে এ অঞ্চলকে দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস আমরা অব্যাহত রাখব।

সোমবার জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দশ দিনের আয়োজনের ষষ্ঠ দিনের অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, দক্ষিণ এশিয়ার এক বিশাল সংখ্যক মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে। বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনও অর্ধাহারে বা না খেয়ে প্রতিরাতে ঘুমায়। অনেকে জীবন ধারণের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় যে প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সে সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার করে এ অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব।

মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘মুজিব চিরন্তন’ প্রতিপাদ্যে দশ দিনের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে বঙ্গবব্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। মঙ্গলবারের আয়োজনের থিম ছিল- ‘বাংলার মাটি আমার মাটি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এছাড়া সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারী।

বিকাল সাড়ে চারটায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সস্ত্রীক অনুষ্ঠানস্থলে এনে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা এবং আয়োজক কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী তাঁকে স্বাগত জানান। এরপর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারীকে অনুষ্ঠানস্থলে স্বাগত জানান।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই শিল্পকলা একাডেমীর শিল্পীরা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ধর্মগ্রন্থ পাঠের পর মূল প্রতিপাদ্য ‘মুজিব চিরন্তন’-এর নির্মিত ভিডিও চিত্র দেখানো হয়। থিম সঙ্গ ‘বাঙালীর ধ্রুবতারা’ এবং সোমবারের অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ‘বাংলার মাটি আমার মাটি’র ওপর নির্মিত ভিডিও চিত্র পরিবেশন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দেশের বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানে উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে সম্মানিত অতিথি নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভারতীকে মুজিব চিরন্তন স্মারক ট্রফি উপহার দেওয়া হয়।

সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা এমন একটি অঞ্চলে বাসবাস করি যা প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দেশগুলো যেমন ভূমিকম্প, ক্লাউড ব্রাস্ট, বরফ ধ্বস, ভূমিধ্বস, ফ্লাস ফ্লাড বা হরকা বান ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ, তেমনি বাংলাদেশের মত সাগর-উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহ বারবার বন্যা, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প, অতিবৃষ্টি বা খরার মত দুর্যোগের সম্মুখীন হয়।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের এ উপমহাদেশের দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি নাজুক করে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের অবদান না থাকলেও আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমরা অভিযোজনের মাধ্যমে সাময়িকভাবে নিজেদের রক্ষা করতে পারি, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা বন্ধ করা না গেলে অভিযোজন প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হবে। তিনি বলেন, বর্তমান গ্লোবাল ভিলেজের যুগ। এখন একলা চলার সময় নয়। আমাদের এ অঞ্চলে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনগণ। আমরা যদি একে অপরের হাত ধরে কাজ করে যাই, তবে এই দক্ষিণ এশিয়াকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত অঞ্চলে পরিণত করতে পারব।

শেখ হাসিনা বলেন, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম বা সিভিএফ-এর বর্তমান সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব নেতৃত্বকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে আসছে। গত বছর ঢাকায় গ্লোবাল ক্লাইমেট এ্যাডাপটেশন, বাংলাদেশ অফিস চালু করা হয়েছে। ঢাকা অফিস দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কাজ শুরু করেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সব সময়ই শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। সকলের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার মত মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের অগ্রগতি থেমে যায়। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন থেকে দেশকে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে শুরু করি।

তিনি বলেন, বিগত ১২ বছরে আমরা জাতির পিতার দেখানো পথ ধরেই হাঁটছি। প্রতিনিয়ত জাতির পিতার দেখানো পথেই দেশকে আমরা উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। গত মাসে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র নেপালও একইসঙ্গে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। দু’দেশের চলার পথ আরও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ হলো। আমি নেপালের সরকার এবং জনগণকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

মহান মুক্তিযুদ্ধে নেপালের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নেপাল আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন নেপাল সরকার এবং সেখানকার জনগণ নানাভাবে স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন। তিনি বলেন, যেসব দেশ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে সর্বাগ্রে স্বীকৃতি দিয়েছিল, নেপাল তার অন্যতম। ১৯৭২ সালে জানুয়ারি মাসে নেপাল বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। আমরা নেপালের জনগণের সে অবদানের কথা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা ২০১২ এবং ২০১৩ সালে নেপালের ১১ জন নাগরিককে ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ সম্মাননায় ভূষিত করি।

সরকারপ্রধান আরও বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দুই দেশের মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। আমাদের মধ্যে ভৌগোলিক নৈকট্য ছাড়াও আমাদের রয়েছে প্রায় একই ধরণের ইতিহাস। আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের অবস্থান প্রায় এক এবং অভিন্ন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, সড়ক, রেল এবং বিমান যোগাযোগ এবং বিদ্যুত, জ্বালানি, বিশেষ করে পানি-বিদ্যুৎ খাত, পর্যটন এবং পানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সহযোগিতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে বিবিআইএন চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। এরফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পাবে। নেপালকে আমরা আমাদের সৈয়দপুর আঞ্চলিক বিমানবন্দর এবং মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। করোনাকালে সবাই স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে চলুন, সবাই ভাল ও সুস্থ্য থাকুন।

বৈশাখী নিউজইডি