বিশ্বসেরাদের কাতারে মুস্তাফিজুর রহমান

কঠিন উইকেটে ফিফটির জন্য ম্যাচসেরা মাহমুদ উল্লাহ অধিনায়কত্বের পরীক্ষাতেও দারুণ করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের পঞ্চদশ বর্ষপূর্তিতে সাকিব আল হাসান মন্দ করেননি। তরুণ শরিফুল ইসলামও মহাগুরুত্বপূর্ণ সময়ে দুটি উইকেট নিয়েছেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের চিরায়ত দলীয় নৈপুণ্যে ম্যাচ জেতার গল্পে গতকাল বিরল একটি ঘটনাও ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের ঐতিহাসিক দিবসে ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার’ তর্কাতীতভাবে মুস্তাফিজুর রহমান। বিরল তো বটেই, উইকেটহীন কেউ ‘এমভিপি’ হয় কী করে?
সেটাই হয়েছেন মুস্তাফিজ। তাঁকে ঘিরে অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহ, নিজের মাইলফলক দিবসে সাকিবের উচ্ছ্বাস নিশ্চয় টিভি পর্দায় দেখেছেন সবাই। ১৯তম ওভার শেষে বাকিদের মুস্তাফিজকে অভিনন্দিত করার দৃশ্য ছোটপর্দার দর্শকের দেখতে পাওয়ার কথা নয়। এক ঝটকায় ম্যাচের ভারসাম্য বদলে দুই ডাগআউটের রূপবদলও দেখা হয়নি টিভি দর্শকের। এটা এমন একটা রোমাঞ্চকর ওভার, যা ইউটিউবে স্মৃতি রোমন্থনের রুদ্ধশ্বাস আয়োজন হয়ে থাকবে নিশ্চিতভাবেই। ‘অপার্থিব’ বিশ্লেষণ ব্যবহারেই সম্ভবত মুস্তাফিজের এই ওভারটির যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া সম্ভব।
অস্ট্রেলিয়ার সিরিজে ফেরার তুমুল সম্ভাবনা তো ওই ওভারটিতেই শেষ করে দিয়েছেন মুস্তাফিজই। ১২ বলে ২৩ রান, হাতে ৬ উইকেট—কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে এসব ডালভাত। মিরপুরের ‘স্পঞ্জি’ উইকেটে না হয় একটু কঠিনই। তবু ম্যাচ তখন সফরকারীদের দিকে ঝুঁকে। মুস্তাফিজের প্রথম বলটাই দুর্বোধ্য কাটার ধরে নিয়ে অন্ধকারে ব্যাট চালিয়েছেন অ্যালেক্স ক্যারি। যথারীতি ব্যাটে-বলে হয়নি, উইকেটকিপার নুরুল হাসান সোহানকেও শরীর মাটিতে ফেলে থামাতে হয়েছে বাড়তি রান। দ্বিতীয় বলটা ডিপ কাভারে খেলে ১ রান নেওয়ার পর যা হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। বেচারা ড্যান ক্রিস্টিয়ান, মনে হচ্ছিল তাঁকে চোখ বেঁধে কেউ নামিয়ে দিয়েছে মুস্তাফিজকে খেলতে! চারটা বলই ডট-ক্রিকইনফোর ধারাভাষ্যকারের কলমে তাঁর দেখা অন্যতম সেরা ওভার।
কোনো সন্দেহ নেই। ১২ বলে ২৩ থেকে এক ঝটকায় যে ওভার ম্যাচ অঙ্ককে ৬ বলে ২২ রানের জটিলতায় ফেলে দিতে পারে, সেটি অভাবিতই। শেষ ওভারের প্রথম বলে ছক্কা হজম করা শেখ মেহেদীর হাসিমুখ নো-বল দিয়েও মুছে যায়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় নতুন অধ্যায় রচনাও বিলম্বিত হয়নি।
অবশ্য একটি ওভারে তো কত তোঘলকি কাণ্ডই ঘটতে পারে ক্রিকেটে। টি-টোয়েন্টিতে একটি বলও ম্যাচের রং বদলে দিতে পারে। কিন্তু মুস্তাফিজ গতকাল ওই একটি ওভারই নয়, যখনই দরকার হয়েছে মাহমুদ উল্লাহ আক্রমণে এনেছেন মুস্তাফিজকে। উইকেট পাননি, তবে অস্ট্রেলিয়ানদের রানের চাকা কাদামাটিতে আটকে দিয়ে গেছেন। সেখান থেকে আবার ছুটতে গিয়ে উইকেট খুইয়েছেন সফরকারীরা। তাই মুস্তাফিজের ৪ ওভারে মাত্র ৯ রান দেওয়ার মূল্য আসলে ম্যাচসেরার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির চেয়েও বেশি।
বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহ অবশ্য এই ম্যাচই শুধু নয়, পুরো সিরিজের জন্যই মুস্তাফিজের পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে, ‘আবারও দুর্দান্ত বোলিং করেছে মুস্তাফিজ। অবিশ্বাস্য বোলিং!’ প্রথম ম্যাচে ১৬ রানে ২ উইকেট। পরেরটায় ২৩ রানে ৩ উইকেট। পাওয়ার প্লে, মিডল ওভার কিংবা ডেথ-এ; যখন দরকার হয়েছে মুস্তাফিজের সর্বোচ্চ সাপোর্ট পেয়েছে বাংলাদেশ দল।
বাংলাদেশ সফরে আসা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাংবাদিকের আফসোস সম্ভবত গতকাল আরো বেড়েছে, চলমান সিরিজে মুস্তাফিজের বোলিং দেখা থেকে যে বঞ্চিত হলো তাঁর দেশের অগুনতি তরুণ! এটা অস্ট্রেলিয়ার একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা। তবে স্কাই স্পোর্টস যদি ‘ফিড’ নিত, তাহলে বাংলাদেশেরও একটা লাভ হতো। একটা বিশেষ ‘ব্র্যান্ড’ দেখানো হতো ক্রিকেট বিশ্বের শক্তিধর ওই প্রান্তকে।
সেই ব্র্যান্ডটি ‘দ্য ফিজ’। অনেকে বলছেন প্রত্যাবর্তন। তবে বাংলাদেশ দলের অন্দরমহলে মুস্তাফিজের দুঃসময়ে কিছুদিন আড়ালে পড়ে থাকা স্রেফ চোটের কারণে। তাঁর সামর্থ্য নিয়ে কোনোকালেই সংশয় প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ দল। সব বোলারের উইকেটের টুকটাক সাহায্য লাগে। উইকেটে বল গ্রিপ করলে ফিট মুস্তাফিজও বিশ্বসেরাদের কাতারে।