জাতীয় শোক দিবসে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী

আপডেট: August 15, 2022 |

আজ ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাত বার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সংঘটিত হয়েছিলো ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। ৪৭ বছর আগে এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ক্ষমতালোভী নরপিশাচ কুচক্রী মহল।

আজ যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর ৪৭তম শাহাদতবার্ষিকী পালনের জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

শোক দিবস উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৫ আগস্ট এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ১৯৭৫ সালের এদিনে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ঘাতক চক্রের নির্মম বুলেটের আঘাতে ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে শাহাদতবরণ করেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই সাথে শহীদ হন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ অনেক নিকটাত্মীয়।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা ও মহান স্বাধীনতার রূপকার। ১৯৪৮ সালে ভাষার দাবিতে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বসহ ১৯৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৫৮-এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর গণবিরোধী শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬-দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭০-এর নির্বাচনসহ বাঙালির মুক্তি ও অধিকার আদায়ে পরিচালিত প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। এজন্য তাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়।

আবদুল হামিদ বলেন, মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধিকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপসহীন। ফাঁসির মঞ্চেও তিনি বাংলা ও বাঙালির জয়গান গেয়েছেন। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু অসীম সাহসিকতার সাথে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভাস্বর ওই ভাষণে বাঙালির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে একসূত্রে গেঁথে বঙ্গবন্ধু বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, যা ছিলো মূলত স্বাধীনতারই ডাক। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং তারই নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি বিজয় অর্জন করে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আজ অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আজীবন সাম্য, মৈত্রী, গণতন্ত্রসহ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন বিশ্বে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের স্বাধীনতার প্রতীক, মুক্তির দূত। ১৯৭৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত-শোষক আর শোষিত: আমি শোষিতের পক্ষে’। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর নীতি ও আদর্শ বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী মানুষের অধিকার আদায়ে এবং শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণজাগরণে সবসময় অনুপ্রেরণা যোগাবে। ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তাঁর নীতি ও আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু এ দেশের লাখো-কোটি বাঙালিরই শুধু নয়, বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্যও প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবেন।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর স্বপ্ন। এ লক্ষ্যে স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় প্রণয়ন করেন একটি গণমুখী সংবিধান। বঙ্গবন্ধু শুধু একটি দেশই উপহার দেননি; তিনি সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো কেমন হবে তারও একটি যুগোপযোগী রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সবসময় জনগণের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখতেন। উন্নয়ন ও স্ব-নির্ভরতা অর্জনে মানুষের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। বঙ্গবন্ধুর দেখানো সেই পথে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে স্বনির্ভর দেশ গড়ার লক্ষ্যে। দেশকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে তিনি ঘোষণা করেছেন ‘রূপকল্প ২০৪১’। বাংলাদেশের উন্নয়নের অনন্য মাইলফলক পদ্মা সেতু ইতোমধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ আরো কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ খুব শীঘ্রই শেষ হবে এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব হবে জ্ঞান-গরিমায় সমৃদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করে বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। তাহলেই চিরঞ্জীব এই মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করলেও তার স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং গণতন্ত্র বিরোধী চক্র এখনও নানাভাবে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এই অপশক্তির যে কোন অপতৎপরতা-ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে আমি সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে আমরা জাতির পিতার হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করেছি। এ হত্যাকান্ডের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। আশা করি, জাতির পিতার হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা ছিল সেটাও একদিন বের হয়ে আসবে। জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারও সম্পন্ন হয়েছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে আমাদের সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে। সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের সুযোগ বন্ধ হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে। আমরা জাতির পিতার হত্যার বিচার শুরু করি। কিন্তু বিএনপি-জামাত জোট ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে এই হত্যার বিচার কাজ বন্ধ করে দেয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে পূর্ববর্তী সরকারগুলোর রেখে যাওয়া অচলাবস্থা এবং বিশ্বমন্দা কাটিয়ে দেশকে দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার কাজ শুরু করে। গত সাড়ে ১৩ বছরে আমরা দেশের প্রতিটি সেক্টরে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন করেছি। এই সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বে ‘রোল মডেল’ হয়েছে। আমাদের সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। জাতির পিতার দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ছিনিয়ে এনেছিল আমাদের মহান স্বাধীনতা। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন সমগ্র জাতিকে নিয়ে সোনার বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে নিয়োজিত, তখনই স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী চক্র তাকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যা করে।

এই হত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাঙালি জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করার অপপ্রয়াস চালায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঘাতকদের উদ্দেশ্যই ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই জঘন্য হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকেই হত্যা, কু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। তারা ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করে জাতির পিতার হত্যার বিচারের পথকে বন্ধ করে দেয়। জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে, সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করে। হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করে বিদেশে দূতাবাসে চাকুরি দেয়া হয়। স্বাধীনতা বিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিকত্ব দেয়া, রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করে। পরবর্তী অবৈধ সামরিক সরকার এবং বিএনপি-জামাত সরকারও একই পথ অনুসরণ করে।

জাতির পিতা হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, তার আত্মত্যাগের মহিমা এবং দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনাদর্শ আমাদের কর্মের মাধ্যমে প্রতিফলিত করে সকলে মিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলি- জাতীয় শোক দিবসে এই হোক আমাদের সুদৃঢ় অঙ্গীকার। সূত্র: বাসস

বৈশাখী নিউজ/ জেপা

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর