ঐতিহাসিক মুজিবনগর শহীদ স্মৃতি কমপ্লেক্সে ভয়াবহ তাণ্ডব


গণ আন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনার পতনের পর মেহেরপুরের মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে শতাধিক দুর্বৃত্ত হানা দেয়। তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলে। গত ৫ আগস্ট বিকেল পাঁচটায় সেখানে একরকম তাণ্ডব পরিচালিত হয়।
এ নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ৫ আগস্ট বিকেল পাঁচটার দিকে শতাধিক যুবক রড, বাঁশ ও হাতুড়ি নিয়ে স্মৃতি কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে। প্রথম তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটির মাথা ভেঙে গুঁড়া করে ফেলে।
একই সময়ে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করে ‘১৭ এপ্রিলের গার্ড অব অনার’ ভাস্কর্যটিতে। আরও একটি দল ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্থনের ভাস্কর্যগুলোতে আঘাত করে।
তবে সেখানে খুব বেশি ভাঙচুর করতে পারেনি তারা। পরে কমপ্লেক্সের মধ্যে দেশের মানচিত্রের আদলে তৈরি করা মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরে যুদ্ধের বর্ণনা সংবলিত ছোট ভাস্কর্যগুলো ভেঙে আশপাশে ছুড়ে ফেলে দেয়।
আরও একটি দল শহীদ স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকটি ভেঙে নিয়ে যায়।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহসান খান বলেন, ৫ আগস্ট পুলিশ সদস্যরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা ঐতিহাসিক মুজিবনগরে হামলা চালায়। পুলিশের কার্যক্রম এখন মোটামুটি শুরু করা হয়েছে। পুলিশের সব সদস্য কাজে যোগ দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মুজিবনগর কমপ্লেক্সের দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ৬০০টি ছোট-বড় ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে।
পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ ছিল ভাস্কর্যগুলো। প্রতিদিন কয়েক হাজার দর্শনার্থী এখানে আসতেন। কমপ্লেক্সের সব ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। কমপ্লেক্সজুড়ে চালিয়েছে লুটপাট।
মুজিবনগর আম্রকাননের অস্থায়ী চায়ের দোকানি তামিম হোসেন বলেন, যখন দুর্বৃত্তরা কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে, তখন আম্রকাননের নিচে থাকা চায়ের দোকানিরা পালিয়ে যান। পুলিশ ও আনসার সদস্যরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান। এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। শহীদ স্মৃতিসৌধের মূল গেটটি ছিল স্টিলের। সেটিও তারা খুলে নিয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যা চালায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের লক্ষ্যে ১৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় সমবেত হন।
বৈদ্যনাথতলা ছিল মূলত একটি আমবাগান। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর এটির নাম পরিবর্তন করে মুজিবনগর রাখা হয়। অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য গঠিত সংগ্রাম কমিটি, প্রতিবেশী দেশ ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। সে কারণে বাঙালি জাতির জন্য মুজিবনগর আম্রকানন অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়।
এম এ জি ওসমানীকে সরকারের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। মুজিবনগরে তৎকালীন সাবডিভিশনাল পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব উদ্দিন আহমদ, বীর বিক্রমের নেতৃত্বে ১২ জন আনসার সদস্য বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এই অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়।
১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ স্থানকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে ১৯৯৬ সালে ওই স্থানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। স্মৃতি কমপ্লেক্সে একটি মানচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরকে দেখানো হয়েছিল।
কমপ্লেক্সে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির স্মারক ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল। সার্বিকভাবে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স, ঐতিহাসিক আম্রকানন, ঐতিহাসিক ছয় দফাকে রূপকের মাধ্যমে উপস্থাপনকারী ছয় ধাপের গোলাপ বাগান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছিল।