লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনই কী একমাত্র সমাধান?

আপডেট: April 13, 2020 |

দেশে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন জেলায় করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তবে এ নিয়ে লকডাউন বাস্তবায়ন ও এর কার্যকারিতা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে।

গতকাল রবিবার (১২ এপ্রিল) করোনাভাইরাসের নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে আইইডিসিআর-এর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে চারটি জেলার মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে।

আগেরদিন নতুন ৯ জেলায় করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তের কথা জানানো হয়। অথচ আইইডিসিআর-এর তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শুরুর দিকে নতুন নতুন জেলায় করোনা আক্রান্ত রোগী বৃদ্ধি পাওয়ার হার ছিল ধীরগতির।

গত ৮ মার্চ তিনজনের শরীরে করোনা সংক্রমণের তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওটাই ছিল বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার প্রথম ঘটনা। তবে সেসময় আক্রান্ত ব্যক্তি কোন জেলার অধিবাসী, সেই তথ্য জানাতো না সংস্থাটি।

এর কয়েকদিন পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানান, প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনা আক্রান্ত তিনজন ছিলেন নারায়ণগঞ্জ ও মাদারীপুরের বাসিন্দা।

গত ২৩ মার্চ আইইডিসিআর প্রথমবার সাতটি জেলার নাম জানায়, যেখানকার মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ওই জেলাগুলো ছিল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, কুমিল্লা, গাইবান্ধা, চুয়াডাঙ্গা ও গাজীপুর। এরপর ৩ এপ্রিল নতুন করে দুটি জেলায়- রংপুর ও কক্সবাজার – করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তের তথ্য জানানো হয়। ৬ এপ্রিলের মধ্যে মোট ১৫টি জেলায় কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর জানানো হয়।

তালিকায় নতুন করে যোগ হয় জামালপুর, নরসিংদী, শরীয়তপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলা।

৯ এপ্রিলের মধ্যে জেলার সংখ্যা ২০ পার করে। তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয় কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী, ময়মনসিংহ, শেরপুর, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ। এর পরদিনই আরো প্রায় ১০টি জেলায় শনাক্ত হয় করোনা আক্রান্ত রোগী। মুন্সীগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ব্রাক্ষ্ণণবাড়িয়া, চাঁদপুর, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, পটুয়াখালী ও বরগুনায় কোভিড-১৯ রোগী পাওয়া যায়।

গতকাল রবিবার (১২ এপ্রিল) আইইডিসিআর জানায় নতুন আরো চারটি জেলায়  ঝালকাঠি, ঠাকুরগাও, লালমনিরহাট, লক্ষ্মীপুর – শনাক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি।

কেন নতুন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাস আক্রান্ত রোগী? 
রবিবার আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, নতুন করে চারটি জেলায় করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সবাই লকডাউনের মধ্যেই এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়েছেন।

‘যাদের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে তাদের প্রত্যেকেই গত এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকা অথবা নারায়ণগঞ্জ থেকে ওই জেলাগুলোতে এসেছেন।

শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও স্বীকার করেন,  নারায়ণগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের গোপনে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নজরে এসেছে তাঁদের। ছুটির মধ্যে নারায়ণগঞ্জ থেকে অন্যান্য জায়গায় পালিয়ে যাওয়া কয়েকজনের সঙ্গেও কথা হয়।

নিম্ন আয়ের অনেকের কর্মস্থলই নারায়ণগঞ্জ। গত ২৬ মার্চ  থেকে কোনো কাজ না থাকায় তারা নিজ নিজ এলাকায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

কেউ কেউ আবার আশঙ্কা করেছেন নারায়ণগঞ্জে তারা যেখানে বসবাস করেন, সেই বাড়িতে বা তার আশপাশে যদি কারো দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায় তাহলে হয়তো সেই এলাকা থেকে আর বের হতে পারবেন না। সেজন্য তারা গ্রামের বাড়ি চলে যান।

আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা মোশতাক হোসেনের ধারণা,  যারা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় সামাজিকভাবে একঘরে করে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে এটি নিয়ে মানুষের মনে এক ধরণের ভীতি তৈরি হয়েছে।

এ কারণে রোগ শনাক্ত হলে বা অনেক সময় উপসর্গ দেখা দিলেও মানুষের মধ্যে পালিয়ে অন্য কোনো এলাকায় চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।

লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনই কী সমাধান? 
করোনাভাইরাস যেন দেশের বিভিন্ন স্থানে না ছড়াতে পারে, তা নিশ্চিত করতে গত ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। তিন দফা বাড়িয়ে সেই ছুটির মেয়াদ নেওয়া হয়েছে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত।

ছুটি শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা ‘লকডাউন’ ও জেলায় প্রবেশ বা সেখান থেক বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকাসহ দেশের অন্তত ১৯ জেলা কার্যত লকডাউনে রয়েছে – অর্থাৎ সেসব জেলা থেকে বের হওয়া বা অন্য জেলা থেকে সেখানে প্রবেশ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আর আংশিক লকডাউন অবস্থায় রয়েছে ১৬টি জেলা।

কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে কেবল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব দিয়ে লকডাউন বা কোয়ারেন্টিন পালন নিশ্চিত করা যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেন মোশতাক হোসেন।

‘লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনের মধ্যে রোগী দ্রুত শনাক্ত করে তাকে আইসোলেশনে নিয়ে যাওয়া, তার আশপাশের মানুষকে কোয়ারেন্টিনে নেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়াই যথেষ্ট নয়, আশপাশের কমিউনিটিকেও সংযুক্ত করতে হবে’- বলেন মোশতাক হোসেন।

মোশতাক হোসেন বলেন, বেশকিছু দেশের জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এখন মানুষকে ঝুঁকি সম্পর্কে অবহিত করা এবং জনসমাজকে সম্পৃক্ত করে কোয়ারেন্টিন কার্যকর করা বা রোগী শনাক্ত করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।

‘মৃদু সংক্রমণ হয়েছে যাদের মধ্যে, তাদের ও তাদের পরিবারের খোঁজখবর নিতে হবে স্থানীয় জনসমাজের মাধ্যমে। তা না করে প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করলে তা অনেকটা পুলিশি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর সেরকম হলে জনগণ সেটাকে মন থেকে মেনে নিতে পারবে না, ফলে ঘটবে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা।’

মোশতাক হোসেন মনে করেন, যাদের মধ্যে মৃদু উপসর্গ রয়েছে তাদের চিকিৎসা ঘরেই করা সম্ভব, কিন্তু তা স্থানীয় জনসমাজের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। তবে যেসব জায়গায় ক্লাস্টার পাওয়া গেছে, সেসব এলাকায় কড়াকড়িভাবে কোয়ারেন্টিন মেনে চলা প্রয়োজন বলে মনে করেন আইইডিসিআর-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ক্লাস্টারের ভেতরে ঘরে ঘরে গিয়ে রোগী শনাক্ত করার কাজেও স্থানীয় কমিউনিটির অংশগ্রহণ জরুরি।

‘স্বাস্থ্য বিভাগ একা ঘরে ঘরে গিয়ে যেমন সবার পরীক্ষা  করতে পারবে না, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাপ দিয়ে সেটি সম্বব নয়। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমেই কেবলমাত্র এটি সম্ভব।’

প্রত্যেক এলাকার স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এলাকার জনসাধারণকে সমন্বিতভাবে আক্রান্তদের শনাক্ত করা থেকে শুরু করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

একদিকে কোয়ারেন্টিন সফল করার জন্য পদক্ষেপ এবং আরেকদিকে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পদক্ষেপ নিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বেশকিছিু দেশ করোনাভাইরাসের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে বলে জানান মোশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘জনসমাজকে সম্পৃক্ত করে এবং কমিউনিটির নেতৃত্বকে প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত করে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই পরিবর্তন করার দায়িত্ব দিলে পরস্থিতির একটি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটবে।’

সূত্র : বিবিসি

বৈশাখী নিউজবিসি

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর