টি টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ডকাপে বিশ্ব চাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া

আপডেট: November 15, 2021 |
print news

সাউদিকে রিভার্স-সুইপ করে শর্ট থার্ডম্যান অঞ্চল দিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দিলেন গ্ল্যান ম্যাক্সওয়েল। বিশ্বকাপ জুড়ে ফ্লপ থাকা এই ব্যাটসম্যানের ব্যাট দিয়েই ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালো অস্ট্রেলিয়া। ২২ গজে উল্লাস করছেন ম্যাক্সওয়েল আর সঙ্গে থাকা মূল নায়ক মিচেল মার্শ। ডাগআউট থেকে পুরো দল ছুটছেন দুর্বার গতিতে।

দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে চলছে আতশবাজির ঝলকানি। সঙ্গেতো মিউজিক আছেই। কিন্তু নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের কানে যেন এসব পৌঁছাচ্ছে না। এসব সুর তাদের কানে যাচ্ছে যেন বিউগলের করুণ সুর হয়ে। কারো যেন নড়ারও শক্তি নেই। ধীরে ধীরে তারা ফিরতে থাকেন প্যাভিলিয়নের দিকে। আরেক পাশে চলতে থাকে হলুদ উৎসব।
ক্রিকেটের সবচেয়ে শান্ত-শিষ্ট দল তারা। ক্রিকেটের সবচেয়ে ভদ্র দল কোনটি, কাউকে এমন প্রশ্ন করলে চোখ বন্ধ করে বলে দেবে যেকেউ- নিউ জিল্যান্ড। এই দলটির নেতৃত্বে আছেন ঋষি খ্যাত কেন উইলিয়ামসন। কিন্তু পুরো মৌসুম জুড়ে, পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে ভালো খেলে এসে ফাইনালের মঞ্চে এসে মুখ থুবড়ে পড়াকে যেন নিয়মে পরিণত করেছেন এই কিউইরাই।

এদিন ভাগ্যের দেবীও যেন মুখ ফিরিয়ে নেন তাদের থেকে। ফাইনালের মঞ্চে অস্ট্রেলিয়াকে ফেবারিট ধরা হলেও মনে-প্রাণে অনেকে চেয়েছেন নিউ জিল্যান্ডের হাতে উঠুক ট্রফিটা। ক্রিকেটের ঋষির হাতে উঠুক ট্রফিটা। সময় যে বড্ড নির্মম!

২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে নিউ জিল্যান্ডকে ৮ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টির ট্রফি ঘরে তোলে অস্ট্রেলিয়া। এর আগে ২০১০ সালে একবার ফাইনালে উঠলেও জয়ের দেখা পায়নি মাইটি অস্ট্রেলিয়া। মনে পড়ে যায় সেমিফাইনালের আগে অজি অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চের একটি কথা। অনেকেই উড়তে থাকা পাকিস্তানকে ফাইনালে ধরে নিয়েছিলেন, ফিঞ্চ ধরেননি, মানেনি। সোজা-সাপ্টা বলে দিয়েছেন মাঠেই এর প্রমাণ হবে। তাইতো, সুপার টুয়েলভে থেকে নানা সমীকরণের বেড়াজাল পেরিয়ে ফাইনালে উঠে ট্রফিটাই নিজেদের করে নিলেন। অথচ এই অস্ট্রেলিয়াকে গোণায় ধরেনি অনেকে। ইংল্যান্ডের কাছে একপেশে ম্যাচে এই দুবাইতেই উড়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ভেঙে যায়নি দল। শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয়েই রাজার মতো টুর্নামেন্ট শেষ করেছে দলটি।
বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ দলীয় রান স্কোরবোর্ডে পুঁজি করেছিল নিউ জিল্যান্ড। এর আগে ২০০৭ সালে ভারতের ১৫৭ রান এতদিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ছিল। কিন্তু তাতেও কিছু হলো না। অনেকেই তখন ২০১৯ ফাইনাল কল্পনা করছিলেন। সাদামাটা ম্যাচে হয়তো শেষ দিকে শ্বাসরুদ্ধকর কিছু হতে পারে। হয়নি। হতে দেননি অজি ব্যাটসম্যানরা। উড়তে থাকা ওয়ার্নারকে ৫৩ রানে থামিয়ে ম্যাচে প্রাণ এনে দিয়েছিলেন ট্রেন্ট বোল্ট। ওয়ার্নার ফিরে যান, আরেক পাশে দাঁড়িয়ে যান মার্শ।

আসলে ভাগ্যটাও ছিল না তাদের পক্ষে। এই মার্শই দুই-দুবার মরতে মরতেও বেঁচে যান। একবার ৪০ রানে ও আরেকবার ৬০ রানে তার ক্যাচ ফিল্ডারের একটু সামনে ড্রপ খেয়ে হাতে যায়। তখন হয়তো অনেক আফসোস হয়েছে, ইশ… অল্পের জন্য। ক্রিকেটটা আসলে এমনই, অল্পের জন্য কেউ জিতে যান, আর কেউ হেরে যান।

সেই মার্শ দলকে জিতিয়ে ৭৭ রান করে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন। তার সঙ্গে ২৮ রানে অপরাজিত ছিলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ওয়ার্নারের সঙ্গে ৯২ আর ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে ৬৬ রানের জুটিতে ম্যাচ বের করে নেন এই ব্যাটসম্যান। কিউইদের হয়ে দুটি উইকেটই নিয়েছিলেন বোল্ট।

টসে যখন অস্ট্রেলিয়া জেতে তখনই হয়তো অনেকে ধরে নিয়েছেন ট্রফিও বুঝি তারা জিতছে! কারণ, দুবাইয়ের এই মাঠে এর আগে ১২ ম্যাচের মধ্যে ১১ ম্যাচই যে জিতেছে পরে ব্যাটিং করা দল। অ্যারন ফিঞ্চও যে ফিল্ডিংয়ই নেবেন তা অনুমতিই ছিল। চোখ বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়েও নিয়েছেন। ব্যাটিং করতে নেমে খুব একটা খারাপ করেনি নিউ জিল্যান্ড। মিচেল স্টার্কের করা প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলে দৃষ্টি নন্দন শটে পয়েন্ট অঞ্চল দিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে রানের খাতা খোলেন মার্টিন গাপটিল। চতুর্থ ওভারে ড্যারেল মিশেলের আউটে ভাঙে ওপেনিং জুটি। পাওয়ার প্লে-তে রান আসে ৩২টি। এরপর শুধু উইলিয়ামসনের গল্প।

বিশ্বকাপের ফাইনালের মঞ্চে যে কেউ-ই নিজেকে মেলে ধরতে চান। কেউ পারেন আর কেউ পারেন না। ক্রিকেটের ঋষি খ্যাত উইলিয়ামসন এ ক্ষেত্রে ফুল মার্কসই পাবেন। এমন বড় মঞ্চে দুর্দান্ত ইনিংসের জন্য ভাগ্যও কিছুটা লাগে। কিউই অধিনায়কের সেটাও ছিল। মাত্র ১৮ বলে ২৯ রান করা এই ব্যাটসম্যান থামেন ৪৮ বলে ৮০ রান করে। পরের ৬৭ রান আসে মাত্র ২৯ বলে। মোড় ঘুরে যায় স্টার্কের ১১তম ওভারে। ফুল টস বলে খেলেছিলেন ফাইন লেগে, ওখানে দাঁড়ানো জস হ্যাজলউড বল তালুবন্দি করতে পারেননি, উল্টো চার হয়ে যায়। এরপরেই দেখা মেলে ধ্রুপদী উইলিয়ামসনের। পরপর আরও দুটি চার আসে তার ব্যাট থেকে। স্টার্কের এই ওভারে আসে ১৯ রান।

কিউইদের পুরো ইনিংস যেন ছিল উলিয়ামসনময়। দ্বিতীয় উইকেটে মার্র্টিন গাপটিলের সঙ্গে উইলিয়ামসন তোলেন ৪৫ বলে ৪৮ রান। গাপটিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৮ রান করেন। এরপর গ্লেন ফিলিপসের সঙ্গে তৃতীয় উইকেটে মাত্র ৩৭ বলে তোলেন ৬৮ রান। আর চতুর্থ উইকেটে জিমি নিশামের সঙ্গে ৩ বলে তোলেন ৪ রান। বিশ্বকাপের ফাইনালে উইলিয়ামসন আজ যৌথভাবে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেছেন। এর আগে ২০১৬ সালের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মারলন স্যামুয়েলস ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করেছিলেন অপরাজিত ৮৫ রান। আজ তাকে ছুঁলেন কিউই দলনেতা। উইলিয়ামসন-গাপটিল ছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যান ত্রিশের ঘর পেরোতে পারেনি। অজিদের হয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নেন জস হ্যাজলউড।

শুরুতে স্টেডিয়ামে দর্শক দেখা যায়নি। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে কিছু দর্শক দেখা গিয়েছে। দুবাই স্টেডিয়ামের ২৫ হাজার আসনের বিপরীতে যা ছিল নগন্য। পুরো স্টেডিয়ামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন দর্শকরা। আসলে নন এশিয়ার দুই দল অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ড হওয়াতে মূলত এমন অবস্থা। তবুও যেসব দর্শকরা মাঠে এসেছেন তাদের মধ্যে ভারত-পাকিস্তানের দর্শকই বেশি। অনেকে জার্সি-পতাকা নিয়েও এসেছেন। নিজেদের দল ফাইনাল খেললেও অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডের দর্শকদের উপস্থিতি খুব একটা দেখা যায়নি।

এ ছাড়া করোনাকালিন ভ্রমণে দেশ দুটির কঠোর বিধিনিষেধের কারণে দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপ থেকে। যে সব অস্ট্রেলিয়ান কিংবা নিউ জিল্যান্ডের মানুষ দুবাইয়ে থাকেন, তাদেরই মূলত বেশি দেখা গেছে। আর সেই সংখ্যাটাও খুবই নগন্য।

বৈশাখী নিউজ/ ইডি

 

 

 

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর