ইউক্রেনে কতটুকু শক্তি প্রয়োগ করছে রাশিয়া?

আপডেট: February 28, 2022 |
print news

পৃথিবীতে যত যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে, তার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, যুদ্ধ শুরু করার চেয়ে শেষ করাটাই বেশি কঠিন। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে ২০০১ সালে আফগানিস্তান ও ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অভিযান এর বড় প্রমাণ।

ইউক্রেনেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষেত্রেও কি ইসিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে?

শত্রুর সঙ্গে প্রথম মোকাবেলায় কোনো সামরিক পরিকল্পনা সুবিধা করতে পারে না, এমন একটি মতবাদ প্রচলিত আছে। আপাতদৃষ্টিতে ইউক্রেনের লড়াইয়েও রুশ বাহিনীর ক্ষেত্রেও সেটাই সত্যি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সমরবিদরা।

রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের (আরইউএসআই) ইউরোপিয়ান নিরাপত্তা বিশ্লেষক এড আরনল্ড রাশিয়ার প্রাথমিক অভিযান ‘আশানুরূপ নয়’ এবং ‘প্রত্যাশার চেয়েও ধীর’ বলে অভিহিত করেছেন।

এর বেশ কয়েকটি কারণও বলেছেন তিনি।

2 2202280242

তার মতে, সাধারণত কোনো আগ্রাসন চালাতে সামরিক পরিকল্পনার একটি সূত্র হচ্ছে, বিপুল সেনা সমাবেশ ঘটানো। ইউক্রেন সীমান্তেও রাশিয়া দেড় থেকে প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি সেনা জড়ো করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই শক্তির পুরো ব্যবহার করেনি।

এর একটি কারণ বলা যেতে পারে, আগ্রাসনের পরবর্তী ধাপে তাদেরকে প্রয়োজন হতে পারে রাশিয়ার। যেকোনো সেনাবাহিনীর জন্যই রিজার্ভ ফোর্স রাখাটা খুবই সাধারণ কৌশল হিসেবেই পরিচিত।

পশ্চিমা দেশগুলোর হিসাবে, ইউক্রেনে প্রাথমিক অভিযানে জড়ো করা সেনাদের অর্ধেক ব্যবহার করেছে রাশিয়া। আর বিভিন্ন দিক থেকে পাল্টা প্রতিরোধ আসায় অভিযানের শুরুটা বেশ জটিলও হয়ে গেছে।

যেমনটা ভাবা হয়েছিল, অভিযানে পদাতিক এবং বিমানশক্তিও তার চেয়েও কম ব্যবহার করেছে রাশিয়া।

এড আরনল্ড বলছেন, “মূল বিষয় হচ্ছে, তারা ইউক্রেনীয়দের কাছ থেকে শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ছে। আমার মনে হয় না, এমনটা তারা আশা করেছে।”

3 2202280243

তবে এই যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাপতি খুব দ্রুতই যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে সক্ষম হবেন বলে ধারণা এই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের।

একই কথা বলেছেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডার জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারনস।

“অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাশিয়ানরা দ্রুতই তাদের সামরিক লক্ষ্য অর্জন করতে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।

জেনারেল ব্যারনস বলেন, “এটা পরিষ্কার যে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে ভেঙ্গে দেয়া, কেন্দ্রীয় সরকারকে উৎখাত এবং মূল বিষয়টিকে বৃহত্তর রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করাই তাদের প্রথম লক্ষ্য।”

এসব লক্ষ্য অর্জনের পথে বেশ কয়েকটিতে এরইমধ্যে অগ্রগতি অর্জন করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হওয়া রাশিয়ানরা এখন ক্রিমিয়া থেকে ইউক্রেনে ঢোকার পথ তৈরি করেছে। ২০১৪ সালে এই ক্রিমিয়াতেই অভিযান চালিয়েছিল পুতিনের দেশ।

এড আরনল্ড এটিকে ‘ছোট লক্ষ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পূর্বাঞ্চলে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া ইউক্রেনীয় বাহিনীকে এখান থেকেই ঘিরে ফেলার চেষ্টা করতে পারে রাশিয়া।

ইউক্রেনের অভিজ্ঞ সেনাদের কিছু অংশ মোতায়েন রয়েছে সংযোগ রেখা বরাবর অবস্থানে। এখান থেকেই তারা গত আট বছর ধরে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।

4 2202280243

দখলকৃত দনেতস্ক ও লুহানস্ককে বিচ্ছিন্ন করতে রাশিয়ানদের চেষ্টা এখন পর্যন্ত সাহসিকতার সাথেই ঠেকিয়ে আসছে ইউক্রেনের এসব সেনা। তবে রুশ ঘেরাটপে আটকে গেলে তাদের কাজটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাবে।

বাস্তব হলো, ইউক্রেন সেনাবাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এরইমধ্যে যুদ্ধের মাঠে রয়েছে এবং তাদের জন্য আগের অবস্থান ফিরে পাওয়াটা কঠিনই হবে।

এরই মধ্যে কিয়েভে রাশিয়ান বাহিনীর ভালো অগ্রগতি হয়েছে। আর রাজধানী দখলই তাদের মূল লক্ষ্য, কারণ কিয়েভই ইউক্রেন সরকার এবং প্রতিরোধের মূল কেন্দ্র।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইচ্ছা হলো- গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জায়গায় নিজের পছন্দের লোক বসানো।

“কিয়েভ দখলের বাইরে অন্যকিছু রাশিয়ার লক্ষ্য নেই,” বলেন এড আরনল্ড।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কতটা সহজ হবে কাজটি? কারণ রাশিয়ান বাহিনী রাজধানীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা যতই গভীরে যাবে, ততই শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়বে।

শহুরে লড়াইয়ে অনেক সময় প্রতিরোধ বাহিনী সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। ফলে শহরের পথের লড়াই অনেকটা কঠিন হয়ে যায় আক্রমণকারী বাহিনীর জন্য। কারণ শহরের ভবনগুলো হয়ে উঠে মূল প্রতিরোধ ঘাঁটি।

সাধারণ নাগরিকরাও প্রতিরোধযুদ্ধ এবং গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনের অংশ হতে পারে। সবমিলিয়ে শহুরে লড়াই একদিকে যেমন অগ্রসরমান সেনাদলের জন্য অনেক বেশি রক্তাক্ত হতে পারে, তেমনি তাদের শক্তি আরো বাড়ানোর প্রয়োজনও হতে পারে।

ইউক্রেনের পূর্ব-পশ্চিমকে প্রাকৃতিকভাবে বিভক্ত করেছে নিপার নদী। রাশিয়ান বাহিনীর অগ্রযাত্রায় একে সম্ভাব্য বাধা হিসেবে বর্ণনা করেছেন এড আরনল্ড।

তিনি বলছেন, রাশিয়ান বাহিনী যদি কিয়েভ এবং দেশটির অন্য অংশগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে তাহলে তাদের আরো পশ্চিমে সরতে কিছুটা সুবিধা হবে। রাজধানী দখল এবং ইউক্রেন সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পর পুতিন নিশ্চয়ই প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার আশা করবেন।

কিন্তু যদিও এক লাখ ৯০ হাজার সেনা অভিযানের জন্য পর্যাপ্ত, তারপরও তারা ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশটিতে দখলদারিত্ব ধরে রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান সামরিক বিশেষজ্ঞরা।

ইরাকে ব্রিটিশ বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করা জেনারেল ব্যারনস বলেন, পুতিনের লক্ষ্য যদি হয় দেড় লাখ সেনা দিয়ে ইউক্রেন দখল করা, তাহলে তা জনগণের সমর্থন থাকলেই কেবল সম্ভব। কারণ রাশিয়া সমর্থিত যেকোনো সরকারকেই টিকে থাকার জন্য চার কোটি জনগণের সমর্থন পেতে লড়তে হবে।

জেনারেল ব্যারনসের বিশ্বাস, রাশিয়ার ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার মতো শক্তি থাকলেও তাদের খুবই শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়তে হতে পারে। ফলে প্রেসিডেন্ট পুতিন পুরোপুরি দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবেন, এমন আশা করলে তা হতে পারে বড় ধরনের ভুল।

সূত্র: বিবিসি

বৈশাখী নিউজ/ এপি

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর