বন্ধুত্বই গড়বে সম্প্রীতির বাংলাদেশ

আপডেট: August 1, 2022 |

মানব সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নাম হচ্ছে বন্ধুত্ব। রক্তের সম্পর্কের বাহিরে গিয়ে, আস্থা-বিশ্বাস ও স্নেহাস্পদ হচ্ছে এ সম্পর্কের ভিত্তিমূল। আত্মার সঙ্গে আত্মার শক্তিশালী বন্ধনের মধ্য দিয়েই এ সম্পর্কের ভিত্তি আরও মজবুত হয়। ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা দিয়ে বন্ধুত্বের মূল্যায়ন হয় না। বন্ধুত্বে টাকা-পয়সা নগণ্য বিষয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণের মানুষজন আমাদের সমাজে বাস করেন। তাদের সঙ্গেই আমাদের চলাফেরা, ওঠাবসা আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। সমবয়সী, প্রতিবেশী, সহপাঠী, অফিসের সহকর্মীদের মধ্যেই আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এমকি একই আদর্শ ও চিন্তা-ভাবনার লোকজনের মধ্যেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে।

প্রতিনিয়ত বিশ্বজুড়ে বন্ধুরা গড়ছে নিত্যনতুন ইতিহাস। সৎ-মননশীল চিন্তা ও কর্ম উদ্যোগ থাকলে বন্ধুরা মিলে যেকোনো কাজেই সফলতা লাভ করতে পারে। বন্ধুত্বের সলতাই ছড়াতে পারে সম্প্রীতির আলো। দেশে যখন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চোখ রাঙাচ্ছে, সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মালম্বীদের ঘর-বাড়ী ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা হচ্ছে, ঠিক তখনই সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে আসলো বিশ্ব বন্ধু দিবস-২০২২।প্রাচীনকাল থেকেই বাঙলায় নানা জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্ম-বর্ণের মানুষজন পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে বসবাস করছেন। একে অপরকে শ্রদ্ধাবোধের মধ্য দিয়েই আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির বজায় রেখে চলছে। সম্প্রীতি বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য।

বাঙালিরা সবর্দা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে। তবুও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধাতে ফাঁক-ফোকর খোঁজে। হিংসা ছড়িয়ে দিয়ে সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়। শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়। সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব নষ্ট করতে একটি চক্র প্রতিনিয়ত অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির পায়তারা করছে। মানুষ ও মনুষত্বের উপর আঘাত করছে। মানবতা ভূলন্ঠিত হচ্ছে।

ইসলাম ধর্মের প্রাণপুরুষ প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স)’কে অবমাননা করে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আরেকটি চক্র এই তথ্যটি যাচাই-বাছাই না করেই উন্মাদনা সৃষ্টি করে, আইন নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির আধুনিক যুগেও বাঙালি মুসলিমদের একটা অংশ হুজুগে থাকে। তথ্যের সততা নিশ্চিত না হয়েই ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে, দলবদ্ধ হয়ে হামলা করে সনাতন ধর্মালম্বীদের ঘর-বাড়ী, দেব-দেবীর মূর্তি ও পূজারস্থানে ভাঙচুর চালায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে সাম্প্রদায়িক নিপিড়ন করে। আবার এর ফাঁকে কেউ কেউ লুটে নিচ্ছে অর্থ-কড়ি ও মূল্যবান জিনিসপত্র। রক্ষা পাচ্ছে না সনাতন ধর্মের নারী, শিশুরাও। আগুন লাগিয়েও তাদের সমুদয় সম্পদ জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। বে-ঘর করা হচ্ছে সংখ্যালঘু জাতিগত সম্প্রদায়কে। সাম্প্রদায়িক অশুভ চেতনা আমাদের সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। সুযোগ পেলেই ছোবল মারে। আসলে হিন্দু হোক বা মুসলমান, সাধারণ মানুষ প্রকৃতপক্ষে অ-সাম্প্রদায়িক। তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দেয় ধুরন্ধর শয়তানরা।

সমাজ থেকে সাম্প্রতিক অপশক্তি রুখার পথ কি? একমাত্র বন্ধুত্বই পারে সাম্প্রদায়িকমুক্ত সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস মোকাবিলার অন্যতম উপায় হচ্ছে বন্ধুত্ব। আমাদের সমাজের সকল শ্রেণি-পেশা ও ধর্ম-বর্ণের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক আরও দূঢ় করতে হবে। চিন্তার জগতের আমূল-পরিবর্তন করতে হবে। দেশের সমৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের মানবিক সমৃদ্ধি গঠনেও কাজ করতে হবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মাঝে মায়া-মমতা, সহমর্মিতা, সমবেদনা আর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দরদী হওয়া। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নয়, আমরা সবাই মানুষ; মহান স্রষ্টার শ্রেষ্ট সৃষ্টি, এই চেতনা ধারণা করা। ধর্মের সঠিক ব্যাখা ও তথ্যউপাত্ত প্রচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

ঘরে-ঘরে বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। একে অপরের বিপদ আপদে পাশে দাঁড়াতে হবে। আজ চিকিৎসা বিজ্ঞান আর জীবনের প্রয়োজনে হিন্দু-মুসলমানের রক্ত আদান-প্রদান হচ্ছে। মুসলিমদের শরীরে বইছে হিন্দুর রক্ত। আবার হিন্দুর শরীরে বইছে মুসলিমদের রক্ত। ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে রক্তের সঙ্গে রক্তের বন্ধন তৈরি হচ্ছে। এই বন্ধনকে আরও মজবুত করা প্রয়োজন। মানুষের মঙ্গলের জন্য ধর্মের সঠিক ব্যাখা ও তথ্য-উপাত্ত প্রচার করার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ধর্মীয় পন্ডিতদের উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি বন্ধুত্বের শক্তি কাজে লাগিয়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ নির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের প্রতিটি পড়া-মহল্লায় সব ধর্মের বন্ধুরা ঐক্যবদ্ধ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। বিদ্যার্থীদের শ্রেণিকক্ষেই দিতে হবে সম্প্রীতির শিক্ষা। প্রতিটি ধর্মের পন্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে গ্রাম-গঞ্জের সর্বত্র মাসে একবার হলেও সম্প্রীতির সভা করতে হবে। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা বেশি। ইসলামসহ সকল ধর্মই মানুষের কল্যাণের কথা বলেছে। কোনো ধর্মই মানুষে-মানুষে দাঙ্গা হাঙ্গামা চায় না। মানুষের অমঙ্গল চায় না। ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। ইসলাম কখনও অন্য ধর্মের মানুষের উপরে আঘাত করতে বলে না। বরং ইসলাম সব সময় সহবস্থানের কথা বলে। ইসলাম প্রতিবেশী বন্ধুর অধিকার রক্ষার কথা বলে। ইসলাম মানুষের সঙ্গে সর্বোত্তম আচরণের কথা বলে।

দেশে যারা ধর্মকে পুঁজি করে অন্য ধর্মের মানুষের ওপরে হামলা করবে বন্ধুরা সবাই মিলে সেই ইবলিশ-অসুরদের প্রতিহত করতে হবে। গ্রিক দর্শনিক মহামতি প্লেট বলেছেন ‘বন্ধুদের মধ্যে সবকিছুতেই একতা থাকে’। বন্ধুত্বের ঐকবদ্ধ শক্তিই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মোকাবিলায় কাজ করতে হবে। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কঠোর থেকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে । আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতিতে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মাঝে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির বন্ধন চীর অটুট রাখতে হবে। এবারের বন্ধু দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক, সম্প্রীতির বাংলাদেশ নির্মাণে সব ধর্মের বন্ধুরা হাঁটবো এক সঙ্গে। বন্ধুত্বের সুর দূর করবে সকল অসুর। বন্ধুত্বের জয় হোক, মানবতার জয় হোক, জয়বাংলা।

রাহাত হুসাইন
লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক

 

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর