ক্ষমতা হারিয়ে যেভাবে দিন কাটছে ইমরান খানের

প্রায় তিন সপ্তাহ আগে অনাস্থা ভোটে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদ খুইয়েছেন ইমরান খান। সাবেক এই ক্রিকেট তারকা এখন ব্লাসফেমি মামলার মুখেও পড়েছেন।

ইমরান খান অভিযোগ করেছেন, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র করে তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তাকে সরাতে চেষ্টা করছে। যদিও এর পক্ষে কোন তথ্যপ্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।

ক্ষমতা হারিয়ে ইমরান খান ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাকিস্তানে তিনি কোন পুতুল সরকার মেনে নেবেন না। তার আহ্বানে দেশজুড়ে বিক্ষোভও হয়েছে।

কিন্তু ক্ষমতা হারানোর পর এখন কী করছেন ইমরান খান? তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কোন দিকে এগোচ্ছে?

কী করছেন ইমরান খান?

ইসলামাবাদ থেকে বিবিসি উর্দু সার্ভিসের সংবাদদাতা আবিদ হুসেইন জানাচ্ছেন, ক্ষমতা হারানোর পর থেকে খুবই ক্ষেপে আছেন ইমরান খান। সেই সময় থেকেই তিনি তার সমর্থকদের জড়ো করার চেষ্টা করছেন, যাতে সরকারকে দেখানো যায় যে, তার অনেক সমর্থন আছে, চাইলে তিনি জনগণকে রাস্তায় নিয়ে আসতে পারবেন।

তার প্রধান দাবি হলো, পাকিস্তানে দ্রুত আগাম নির্বাচন দিতে হবে।

আবিদ হুসেইন বলছেন, তিনি যা বলে যাচ্ছেন, তা হলো বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে তার সরকারকে সরানো হয়েছে। এটা আসলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র। সুতরাং সবাইকে পথে নেমে আসতে হবে, সবাইকে বিক্ষোভে অংশ নিতে হবে এবং আগাম নির্বাচনের দাবি তুলতে হবে।

ক্ষমতা হারানোর পর পাকিস্তানের একাধিক শহরে মিছিল-সমাবেশ করেছেন ইমরান খান। এর মধ্যে রয়েছে করাচি, পেশাওয়ার, লাহোর। সব জায়গাতেই তিনি প্রায় একই ধরনের বক্তব্য তুলে ধরেছেন।

মে মাসের শেষ নাগাদ ইসলামাবাদ অভিমুখী বিশাল একটি মিছিল করার ঘোষণা দিয়েছেন ইমরান খান। তিনি বলেছেন, তার এই মিছিল হবে পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে বড়।

এর আগে বিভিন্ন সময় তিনি বলেছেন, তার ডাকে ইসলামাবাদে ২০ লাখের বেশি মানুষ জমায়েত হবে বলে তিনি আশা করেন। এই সমাবেশের মাধ্যমে তিনি এমন পরিবেশ তৈরি করতে চান, যাতে পাকিস্তানের সরকার আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।

আমি পাকিস্তানকে দেখিয়ে দিতে চাই, এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় আন্দোলন। মানুষজন প্রস্তুত আছে, আমরা ডাকলে তারা আজই পথে নেমে আসবে। কিন্তু আমি চাই, এটা হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড়।

তবে ইমরান খানের পরিকল্পনার বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে বলছেন আবিদ হুসেইন। কারণ মে মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে প্রচণ্ড গরম পড়ে।

এই সময় বেশ কয়েকটি তাপদাহ বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার মধ্যে লাখ লাখ মানুষের পক্ষে মিছিল সমাবেশ করে সরকারকে বাধ্য করার মতো কর্মসূচী সফল করার কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

নির্বাচন পর্যন্ত জনপ্রিয়তা ধরে রাখা হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ

ক্ষমতা হারানোর পর মিছিল সমাবেশ আর বিক্ষোভ প্রকাশের ওপরে জোর দিয়েছেন ইমরান খান। যেদিন ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন মি. খান, সেদিনই তার আহ্বানে পাকিস্তানের রাস্তায় নেমে এসেছিল লাখ লাখ মানুষ।

পরদিন পিটিআই রাজনৈতিক কমিটি একটি বৈঠক করেছে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এখন থেকে তারা সভা-সমাবেশ করার মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মসূচী অব্যাহত রাখবে।

পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খান বলেছেন, তিনি পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করেছেন, তাই সেখানে আর যাবেন না। বরং পিটিআই এখন তৃণমূল পর্যায় থেকে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করবে। এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা হবে।

কিংস কলেজ লন্ডনের ওয়ার স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক আয়েশা সিদ্দিকা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ইমরান খান এখন চেষ্টা করছেন জনগণের সামনে এমন একটা চিত্র তুলে ধরার যে, আন্তর্জাতিক এবং আমেরিকান ষড়যন্ত্রের কারণেই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে।

দশকের পর দশক পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও দেশটিতে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে ‘বিদেশি চক্রান্ত’ ধারণাটি বারবার ব্যবহার করা হয়েছে।

”তিনি চাইছেন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠুক, তাকে একজন ভুক্তভোগী হিসাবে দেখুক এবং তাকে ভোট দিক। কিন্তু যতই দিন যাবে, তত মানুষের এই আবেগ কমতে থাকবে। বিশেষ করে নতুন সরকার যদি পাকিস্তানে অর্থনৈতিক স্বস্তি এনে দিতে পারে, বিদেশ থেকে নতুন অর্থকড়ির যোগাড় করতে পারে, তাহলে ইমরান খানের প্রতি মানুষের সেই আবেগ আরও কমে যাবে। ফলে ইমরান খানের আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাও কমতে থাকবে,” বলছেন আয়েশা সিদ্দিকা।

খেলোয়াড়ি জীবনে ইমরান খান তার দলের খেলোয়াড়দের একবার বলেছিলেন কোণঠাসা হয়ে পড়া বাঘের মত লড়াই করতে।

মনে হচ্ছে তিনি এখন এক ‘কোণঠাসা বাঘের মত’ শক্তিশালী বিরোধী চরিত্রে পরিণত হতে যাচ্ছেন।

ইসলামাবাদে বিবিসির সংবাদদাতা আবিদ হুসেইন বলছেন, ইমরান খান চাইছেন যেভাবেই হোক, এমন একটা পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে সরকার আগাম নির্বাচনের কথা বিবেচনায় নিতে বাধ্য হয়।

কিন্তু এভাবে পাকিস্তানে সরকারকে আগাম নির্বাচনে বাধ্য করা যাবে বলে অধ্যাপক সিদ্দিকা মনে করেন না। শুধু মিছিল সমাবেশ করে নির্বাচনে জয় আসবে না। আবেগ বা আদর্শিক রাজনীতি এক বিষয়, আর নির্বাচনে জিতে আসা পুরো ভিন্ন বিষয়। আবেগের দিক থেকে ইমরান খান বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু তার এসব এসব দাবি যদি তিনি প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে হয়তো তার জন্য জয় পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। আমার ধারণা, সামনের নির্বাচনে তার দলের আসন আরও কমে যেতে পারে।

অন্যদিকে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনও জানিয়ে দিয়েছে, প্রায় ১১ মাসের আগে তাদের পক্ষে দেশে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে না।

ইমরান খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে, ব্ল্যাসফেমির মামলাও হয়েছে। অধ্যাপক সিদ্দিকার মতে, ইমরান খান যদি নমনীয় হন, তাহলে হয়তো সরকার তার ক্ষেত্রে বেশি কিছু করবে না। কিন্তু তিনি রাজনীতি শক্ত বিরোধী ভূমিকা নিলে সরকারও হয়তো তার জন্য কঠোর হয়ে উঠবে।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। ইমরান খান ২০১৮ সালে যখন ক্ষমতায় আসেন, তখনো তার নির্বাচনে বিজয়ের পেছনে দেশটির সেনাবাহিনীর ভূমিকা তার বিজয়ের পথ তৈরি করে দিয়েছে- এমন কথাই প্রচলিত ছিলো।

কিন্তু এক পর্যায়ে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগ নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়ান তিনি। গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ পরবর্তী সেনাপ্রধান হবেন বলে আশা করছিলেন, কিন্তু যাতে রাজি ছিলেন না সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া। এই দুজনের বিরোধের মাঝে পড়ে যান ইমরান খান।

ইমরান খানের পতনের পেছনে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির ইঙ্গিত দিয়েছেন অনেক বিশ্লেষক। সেই পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন দেখতে পান না আয়েশা সিদ্দিকা।

ইমরান খানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক এর মধ্যেই খারাপ হয়ে গেছে। বর্তমান সেনাপ্রধান বাজওয়ার সঙ্গে ইমরান খানের সম্পর্ক ভালো নয়। সেনাপ্রধান বাজওয়া নভেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিনে সেই সম্পর্কের উন্নয়নের কোন সম্ভাবনা আমি দেখতে পাই না। তার যদি মেয়াদ বাড়ে বা নতুন যে সেনাপ্রধান আসবে, তার সঙ্গেও রাতারাতি ইমরান খানের সম্পর্ক তৈরি হবে, এমনটা মনে হয় না।

বর্তমানে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানে তেহরিক ই ইনসাফ পার্টি যেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করেছে, যেটা তারা ভালো চোখে দেখছে না। এটিও নির্বাচনে ইমরান খান বা তার দলের বিপক্ষে ভূমিকা রাখবে।

অধ্যাপক আয়েশা সিদ্দিকা মনে করেন, ক্ষমতায় থাকার সময় ইমরান খান অনেক রাজনৈতিক ভুল করেছেন। সামরিক বাহিনী বা অন্য দলের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বাদ দিলেও, তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল নিজের দলটিকেই ঠিক মতো তৈরি করতে না পারা।

কিন্তু রাজনৈতিক এসব ভুল থেকে ইমরান খান কোন শিক্ষা নিয়েছেন বলে মনে করেন না অধ্যাপক আয়শা সিদ্দিকা। কারণ এখনো ইমরান খান রাজনৈতিক দল বা কৌশলের চেয়ে নিজের জনপ্রিয়তার ওপরেই বেশি নির্ভর করছেন।

বিবিসির সংবাদদাতা আবিদ হুসেইন বলছেন, ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ মূলত এক ব্যক্তির দল। সব প্রদেশেই তার সমর্থন রয়েছে এবং তার প্রতি দলের নেতা-কর্মীদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন নেই।

কিন্তু ইমরান খান যদি আগাম নির্বাচনের দাবিতে জোরালো মিছিল, সমাবেশ বা আন্দোলন শুরু করেন, তখন বর্তমান সরকার বা এস্টাবলিশমেন্ট (সেনাবাহিনী) কতদিন সেটা সহ্য করে যাবে, সেটা পরিষ্কার নয়। কিন্তু কোন এক সময় যদি তারা ইমরান খানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, সেটা অনেক কঠোর হয়ে উঠবে, বলছেন হুসেইন। সূত্র: বিবিসি

বৈশাখী নিউজ/ বিসি