ড. জহুরুল ইসলাম: শিক্ষার দীপ্তি ছড়ানো এক উদীয়মান তারকা

আপডেট: May 17, 2025 |
IMG 20250517 WA0018
print news

শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষা প্রশাসন, গবেষণা উন্নয়ন বা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যে কোন কিছু সকল সময়ে সকল সমাজে সকল সভ্যতায় অত্যন্ত গুরুতর বিষয় হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। নগর রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্র, রাজকার্য থেকে তৃণমূলের উন্নয়ন বা প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে ক্রমাগত আধুনিকতর সময়ের পথে অগ্রসর হবার বিরতিহীন যাত্রায় সুষম শিক্ষাই একমাত্র হাতিয়ার। আর এই শিক্ষাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যারা ছড়িয়ে দেন তাঁরা শিক্ষক।

ব্যক্তি হিসেবে শিক্ষা, গবেষণা, সংস্কৃতি, সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং ইতিবাচক পরিবর্তনে বিশেষ তাড়না থাকায় ২০২০ সালে ব্যাংকিং পেশাকে বিদায় জানিয়ে পুরোপুরি শিক্ষকতা শুরু করি। ছাত্র জীবন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অসাধারণ সব শিক্ষকদের সান্নিধ্য পাওয়াতে শিক্ষকতা একই সাথে উপভোগ্য এবং অর্থপূর্ণ মনে হয়। এই পেশায় যুক্ত হবার ফলে অনেক প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বের সাথে কাজ করার এবং তাঁদের থেকে শেখার সুযোগ পেয়েছি। এসকল বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে একজনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি অধ্যাপক ড. মোঃ জহুরুল ইসলাম।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষা, গবেষণা এবং মানব উন্নয়নকে যে সীমিত সংখ্যক গবেষক ও শিক্ষক আরেকটু এগিয়ে নেয়ার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক ড. মোঃ জহুরুল ইসলাম অন্যতম। তুখোড় আইনজীবী হবার সম্ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে হয়েছেন শিক্ষক। বিগত ২৫ বছর ধরে শিক্ষা, শিক্ষা প্রশাসন, গবেষণা, মানব উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন নিবিষ্ট চিত্তে।

Screenshot 2025 0517 201543
দেশের এই বহু পরিচয়ে পরিচিত ডাইকসাইটে শিক্ষাবিদের জন্ম ১৯৭৪ সালের পহেলা ডিসেম্বর। রাজবাড়ী জেলার শাইলকাটি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই গুনীজন। শিক্ষার আবেশেই তাঁর বেড়ে ওঠা। নিজ এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেষ করেন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের পাঠ। পরে ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ১৯৯১ সালে বিজ্ঞান শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯১-১৯৯২ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অনার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হন এবং বিশেষ কৃতিত্বের সাথে ১৯৯৭ সালে অনার্স এবং ১৯৯৮ সালে মাস্টার্স শেষ করেন।
শিক্ষা জীবন শেষে তরুণ জহুরুল ইসলাম রাজবাড়ী জেলা আদালতে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে পেশা জীবন শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে যুক্ত হবার অভিপ্রায় নিয়ে ঢাকায় গমন করেন। হাইকোর্টে প্রাকটিস চলাকালিন কাজের সুযোগ পেয়ে যান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টে (ব্লাস্ট)। সেখানে নারী শ্রমিকের আইনী অধিকার প্রজেক্টে প্রায় ২ বছর কাজ করেন। এ সময়ে তিনি শ্রমিকদের জন্য আইন বিষয়ে সচেতনা কর্মশালা পরিচালনা করার পাশাপাশি তাদের আইনী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করতে থাকেন। এ সময়ে গবেষণায় হাতে খড়ি হয় দেশের প্রথিতযশা আইনজীবী ও তৎকালীন ব্লাস্টের উপদেষ্টা ড. শাহদীন মালিকের হাত ধরে।
তবে শুরু থেকেই অধ্যাপক ড. মোঃ জহুরুল ইসলাম তাঁর গবেষণা দক্ষতাকে শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর ব্যাপারে দৃড়ভাবে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। সে বিষয়ে তিনি পরামর্শ পেয়েছিলেন উনারই শিক্ষক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. বদর উদ্দীনের থেকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালের আগস্ট মাসে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে তরুণ জহুরুল ইসলাম শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
শুরু থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন একজন শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রহণ করেন নানাবিধ কর্মসূচি। শিক্ষার্থীদের উজ্জিবিত রাখতে বিভিন্ন সেমিনার এবং কর্মশালার আয়োজন করেন এবং সেখেনে সমাবেত করেন দেশের সুপরিচিত আইনজীবীদের। শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিচালনা করেন বিভিন্ন গবেষণা কর্ম যা ফলাফল আকারে প্রকাশিত হয়। এসকল গবেষণার মধ্যে উল্লেখযোগ্য “নির্বাচনী আইন সংস্কার” ও “বাংলাদেশে ন্যায়পাল নিয়োগ-স্বপ্ন আর কতদূর?” (২০০১)। গবেষণায় এই বিরতিহীন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তৎকালীন সময়ে আইন শিক্ষায় দেশের অন্যতম কনিষ্ঠতম ‘ডক্টরেট ডিগ্রীধারী’ হবার গৌরবও অর্জন করেন তিনি।
বাংলাদেশের আইন শিক্ষার রুপরেখায় দৃশ্যমান পরিবর্তন হয় অধ্যাপক ড. মোঃ জহুরুল ইসলামের হাত ধরেই। ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশনের তত্ত্বাবধানে উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রকল্প অর্জন করেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষার আধুনিক কারিকুলাম প্রণীত হয়। আইন শিক্ষার কার্যকর পদ্ধতি প্রবর্তনে প্রকাশ করেন ‘প্রব্লেম হ্যান্ডবুক’ ও ‘কেস ল হ্যান্ডবুক’। এছাড়া দেশের প্রথম জুরিস্টিক ক্লিনিক(ল ক্লিনিক) প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সেই প্রকল্পের অধীনেই প্রতিষ্ঠা করেন ডিজিটাল মুটকোর্ট গ্যালারী, ডিজিটাল লাইব্রেরিসহ আরও বেশ কিছু শিক্ষার্থীবান্ধব অবকাঠামো।
শিক্ষা উন্নয়ন এবং গবেষণার প্রতি অন্তপ্রাণ অধ্যাপক ড. মোঃ জহুরুল ইসলাম তাঁর কর্মময় জীবনে ন্যুনতম বিরতি না নিয়ে ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়। যার অবস্থান কুষ্টিয়াতে। দেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নামে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এটিই প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের দক্ষীণ-পশ্চিম অঞ্চলের এই উদীয়মান বিদ্যাপীঠ ইতোমধ্যে হয়ে উঠেছে তারুণ্যের প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষা, গবেষণা এবং মানব উন্নয়নে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের শিক্ষার অবারিত সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই বিদ্যাপীঠ সুবিধা বঞ্চিত প্রান্তিক মেধাবি জনগোষ্ঠীর শিক্ষা নিশ্চিতকরণে বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষা,গবেষণা ও অবকাঠামোর মান সমুন্নত রাখার প্রশ্নে অধ্যাপক ড. মোঃ জহুরুল ইসলাম একটি অবিসংবাদিত নাম। পাশাপাশি দেশের তরুণ প্রজন্মকে তথ্য প্রযুক্তি সমৃদ্ধ শিক্ষা গ্রহণ ও ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং নতুন নতুন পেশায় যোগ্য করে গড়ে তুলতে গত ২০১৯ সাল থেকে মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটে বেরিয়েছেন অবিরাম এবং হাজার হাজার তরুণ শিক্ষার্থীকে ভিন্ন ধারার ক্যারিয়ার প্ল্যানিং এ উদবুদ্ধ করেছেন তিনি। তাছাড়া শ্রমিকসহ নানান পেশার মানুষের দক্ষতা উন্নয়নের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের নেতৃত্বের আসনে রয়েছেন ড. ইসলাম। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাগ্রত শিক্ষা এওয়ার্ড (২০২৩) অর্জন করেন তিনি।
রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়কেও তিনি তথ্য প্রযুক্তি ও কর্মমুখী শিক্ষায় এক ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে চলেছেন। অত্র প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম ও ইন্সট্রাকশনাল উন্নয়নে চালকের আসনে রয়েছেন এই কৃতি শিক্ষাবিদ। ২০২০ সাল থেকে আমি অত্র প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছি। করোনাকাল ও তৎপরবর্তী সময়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাঁর ক্যারিসমেটিক নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত শিক্ষা তত্ত্ব, শিক্ষা পদ্ধতি ও আউটকাম বেইজড কারিকুলাম প্রণয়নের বেশ কয়েকটি টিচিং কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছি। ২০২১ সালের ৫-৮ অক্টোবর ৪ দিন ব্যাপী কর্মশালায় অংশগ্রহণ আমার শিক্ষকতা পেশার একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। অনলাইন, ব্লান্ডেড ও হাইব্রিড লার্নিং সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাই এই কর্মশালা থেকে। ব্লমস টেক্সোনমির ডমিইন ব্যবহার করে কারিকুলাম, সিলেবাস ও পাঠ টীকা প্রণয়নের হাতে কলমে শিক্ষা গ্রহণ করি এই দক্ষ শিক্ষাবিদের কাছ থেকে। নিয়মিত বিরতিতে প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হয় শিক্ষকগণের রিফ্রেসার্স প্রোগ্রাম যা মূলত ড. ইসলামের মস্তিষ্ক নিঃসৃত এবং তিনিই বেশীরভাগ সেশন পরিচালনা করেন। সর্বশেষ গত ১০ জুন (২০২৪) তারিখে অনুষ্ঠিত হয় রিচার্ড মায়ারের কগনেটিভ থিওরি ও মালটিমিডিয়া লার্নিং নিয়ে, যা আমার কার্যকর ইন্সট্রাকশনাল ডিজাইন প্রণয়নে ও ডিজিটাল টুলস বিশেষ করে ক্লাস রুমে মালটিমিডিয়া ও মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে আমি মালটিমিডিয়া ব্যবহার মায়ারের ১২ নীতি মেনে চলার চেষ্টা করি। এতে আমি পূর্বের চেয়ে বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করি এবং শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে ইতিবাচক ফিডব্যাক পাই। ইহা আমার শিক্ষাকতা জীবনে অত্যন্ত উপভোগ্য অংশ।
তাঁর প্রণীত কারিকুলাম মডেল অনুসরণে ও ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের ফলে আমার বিভাগের (ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ) কারিকুলাম প্রণীত হয়েছে। শুধু আমার বিভাগ নয়, রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগই ওবিই কারিকুলাম সমৃদ্ধ। তাঁরই নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের কারিগরি, টেকনোলজি ও সফট স্কিল উন্নয়নের জন্য রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে সংযুক্ত হয়েছে কম্পিউটার নেটওর্কিং, ডাটা এনালিটিকস এবং বেসিক গ্রাফিক ডিজাইনের মত ২৫টি প্রফেশনাল কোর্স যার মধ্য হতে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দ মত ক্যারিয়ারের জন্য উপযোগী ৩টি বিষয় পছন্দ করবে। আগামী ২ বছরের মধ্যে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ সব উদ্যোগের সুফল ভোগ করতে শুরু করবে।
সমসাময়িক বাংলাদেশের শিক্ষা উন্নয়ন ও সম্প্রোসারণে যে কতিপয় ব্যক্তি বিরতিহীনভাবে কাজ করে চলেছেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড. মোঃ জহুরুল ইসলাম অনস্বীকার্যভাবে অন্যতম। তাঁর শিক্ষা ও গবেষণা বাংলাদেশের আইন অধ্যায়নকে যেমন দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা তেমনি ইন্সট্রাকশনাল ও কারিকুলাম উন্নয়নে রয়েছে তাঁর অনবদ্য অবদান। পরিশেষে একই সাথে শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষা প্রশাসক, শিক্ষা উদ্যোক্তা প্রভৃতি পরিচয়ে পরিচিত অধ্যাপক ড. মোঃ জহুরুল ইসলাম যেমন মহিরুহে পরিণত হয়েছেন তেমনি দেশ, সমাজ, মানুষেরও রয়েছে তাঁর নিকট উচ্চতর প্রত্যাশা।

মোফরাদ হোসেন

লেখক: শিক্ষক, কুষ্টিয়া রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর