জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ ১৩৩ শিশু

আপডেট: August 4, 2025 |
inbound4921044787045565043
print news

গত বছরের জুলাই মাসের গণ–অভ্যুত্থানে কমপক্ষে ১৩৩ শিশু শহীদ হয়েছে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এই তথ্য জানা গেছে। শিশু বলতে এখানে ২০১৩ সালের শিশু আইনে বর্ণিত ১৮ বছরের নিচের সবাইকে বোঝানো হয়েছে।

শহীদ হওয়া শিশুদের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ৯১ জন এবং অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন খাতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা শিশু ছিল ৪১ জন। এর বাইরে সবচেয়ে ছোট শহীদ শিশু ছিল চার বছরের আবদুল আহাদ।

আবদুল আহাদ রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে ১১ তলা একটি ভবনের ৮ তলায় বাবা–মায়ের সঙ্গে বাস করত। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে বাসায় খেলতে খেলতে বারান্দায় দাঁড়ানো অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয় সে।

বাবা আবুল হাসান জানান, সেদিন হঠাৎ নিচ থেকে বিকট শব্দ শুনে তিনি, স্ত্রী ও আহাদ বারান্দায় যান। তখন আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে হেলমেট পরা অস্ত্রধারীরা আন্দোলনকারীদের দিকে এবং ওপরের দিকে গুলি করছিল।

গুলিটি আহাদের ডান চোখ ভেদ করে মাথায় লাগে। পরদিন ২০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। আহাদের মৃত্যুর দুই মাস পর পরিবারটি বাসা ছেড়ে মিরপুর–১ নম্বর এলাকায় চলে যায়।

আহাদের মতো বাসায় থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে আরও তিন শিশু—মিরপুরের সাফকাত সামির (১০), উত্তরার নাঈমা সুলতানা (১৫) ও নারায়ণগঞ্জের রিয়া গোপ (৬)। নাঈমার মা আইনুন নাহার জানান, ১৯ জুলাই বিকেলে উত্তরার বাসার বারান্দায় কাপড় আনতে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় নাঈমা। সে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল এবং চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখত।

গণ–অভ্যুত্থানে প্রথম কোনো শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৭ জুলাই। ভোলার মো. সিয়াম (১৫) ঢাকায় খালাতো ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে এসে যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার খালাতো ভাই মো. রাসেল হোসেন জানান, সেদিন বিকেলে সিয়াম গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঘটনাস্থলেই মারা যায়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট অনুযায়ী, ২ আগস্ট পর্যন্ত শহীদদের সরকারি তালিকায় ছিল ৮৪৪ জনের নাম। পরে ৩ আগস্ট রাতে নতুন গেজেটে ৮ জনের নাম বাদ দিয়ে সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৩৬। বাদ পড়াদের মধ্যে এক শিশুসহ চারজনের নাম ছিল দুবার, আর চারজন সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন না।

প্রথম আলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শহীদ শিশুদের মধ্যে মেয়েশিশু ছিল মাত্র চারজন—রিয়া গোপ, নাঈমা সুলতানা, রিতা আক্তার (১৭) ও নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭)। রিতা ও নাফিসা সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল এবং দুজনই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, শহীদ শিশুদের মধ্যে ৮৮ শতাংশ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলা পদচারী–সেতুর কাছে পুলিশ কাছ থেকে একের পর এক গুলি করে হত্যা করে ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়া (১৭)–কে। সে নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজীনগর এমডব্লিউ কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। তার ভাই রবিউল আউয়াল জানান, তায়িম হত্যার পর তাদের বাবা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে এক হাত ৭০ শতাংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছেন।

আশুলিয়ার শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র আস সাবুর (১৪)–এর অর্ধপোড়া লাশ পায় পরিবার। তার ভাই রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্র–জনতার আন্দোলন দমন করতে গুলি করার নির্দেশ শেখ হাসিনাই দিয়েছিলেন, এটি এখন নানাভাবে প্রমাণিত। আমরা চাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।’

শিশু শহীদদের মধ্যে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র শাহারিয়ার খান আনাস (১৬) এখনো মানুষের মুখে মুখে। ৫ আগস্ট বিক্ষোভে যোগ দিতে যাওয়ার আগে সে মাকে চিঠি লিখেছিল—‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। মৃত্যুর ভয়ে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ।’ সেদিন রাজধানীর চানখাঁরপুলে গুলিতে মারা যায় আনাস।

রাজধানীর মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া (১৭), সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ফারহান ফাইয়াজ’ নামে পরিচিত, ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর একদিন আগে সে ফেসবুকে লিখেছিল, ‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী এই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘শিশু–কিশোরসহ নিরস্ত্র মানুষ হত্যার এই ঘটনা জাতির মুখে কলঙ্ক লেপে দিয়েছে। তবে আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বুক পেতে দিয়েছিল সবাই, যা গর্বের।’

তথ্যসূত্র: প্রথম আলো

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর