বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যার এক বছর

বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হলো আজ (২৬ জুন)। গত বছরের এই দিনে সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রিফাতকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে কিশোর গ্যাং বন্ড বাহিনী। এরপর বিকেলেই বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন রিফাত।

রিফাতের মৃত্যুর একদিন পর ২৭ জুন তার বাবা মো. আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ছেলে হত্যার অভিযোগে ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১২-১৩ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। দ্রুত গতিতে এ মামলার বিচার কাজ চলমান থাকলেও দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় থেমে আছে বিচার কাজ। এ ছাড়াও রিফাত হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই এখনও পলাতক রয়েছে এ মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ৬ নম্বর আসামি মো. মুসা বন্ড।

এদিকে রিফাতের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে তার বন্ধুরা। নিহত রিফাতের রুহের মাগফেরাত কামনায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে পারিবারিকভাবেও। এছাড়াও স্বল্প পরিসরে দোয়ার আয়োজন করেছেন রিফাতের শ্বশুর মো. মোজাম্মেল হোসেন কিশোরও।

পুলিশ ও মামলার তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে নৃশংসভাবে কুপিয়ে রিফাতকে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায় বন্ড বাহিনী। রিফাতের ওপর এমন হামলার একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর এ হামলার ঘটনায় দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। দাবি ওঠে- ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের।

রিফাতের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে হামলার দিন সন্ধ্যায় এক কিশোরকে গ্রেফতারের মধ্যে দিয়ে এ মামলার আসামিদের গ্রেফতার শুরু করে পুলিশ। এরপরই একে একে গ্রেফতার হতে থাকে এ মামলার অন্য আসামিরা। এরই মধ্যে রিফাতের ওপর হামলার ছয়দিন পর গত বছরের ২ জুলাই ভোররাতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় এ মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড।

Minni-Rifat2.jpg

অন্যদিকে রিফাত হত্যাকাণ্ডের ২০ দিন পর গত বছরের ১৬ জুলাই নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রধান সাক্ষী থেকে মিন্নি আসামি হয়ে যাওয়ায় মামলাটি মোড় নেয় অন্যদিকে। রিফাতের উপর নৃশংস হামলা এবং ঘটনার ব্যাপকতায় এ হত্যাকাণ্ড সংশ্লিষ্ট সংবাদ স্থান পায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, রিফাত হত্যাকাণ্ডের দুই মাস ছয়দিন পর গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিকেলে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই ভাগে বিভক্ত করে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এদের মধ্যে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক আসামি এবং ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। তদন্ত প্রতিবেদনে নিহত রিফাতের স্ত্রী এবং এ মামলার প্রধান সাক্ষী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে করা হয় ৭ নম্বর আসামি।

আদালত সূত্রে আরও জানা গেছে, বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এ মামলার প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিচার কাজ শুরুর জন্য গত ১ জানুয়ারি সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মামলাটি বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠান। এরপর গত ৮ জানুয়ারি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ মামলার ৭৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্নের মধ্য দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিরুদ্ধের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করে আদালত।

আর এ মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিচার কাজ শুরুর সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গত ৮ জানুয়ারি জেলা নারী ও শিশু আদালতে পাঠান সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এরপর এ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ ব্যতীত অন্য ৭৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করেন আদালত।

এদিকে প্রায় শেষ পর্যায়ে মামলার বিচারকাজ থেমে থাকা নিয়ে নিহত রিফাতের বাবা ও মামলার বাদী মো. আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে আমার ছেলে হত্যার বিচারকাজ থেমে আছে। আমি প্রত্যাশা করি খুব দ্রুত আবার আদালতের কার্যক্রম শুরু হবে এবং আমার ছেলে হত্যার বিচারকাজ আবার শুরু হবে।

Minni-Rifat2.jpg

ছেলে হত্যার ন্যায় বিচার চেয়ে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকার এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতার এবং দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করার জন্য যথেষ্ট আন্তরিক ছিল বলে রিফাত হত্যা মামলার বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন হওয়ার পথে। প্রতিটি ঘটনায় যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন আন্তরিক থাকে তাহলে এদেশ থেকে একদিন অপরাধ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

রিফাতের মা ডেইজি বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, রিফাতের জন্মের পর আমি ওকে ছাড়া কোথাও গিয়ে থাকিনি। আজ এক বছর হলো রিফাত নেই। সন্তান হারানোর ব্যথা একমাত্র মা-ই জানে।

তিনি বলেন, এ বছর চিকিৎসার জন্য রিফাত আমাকে ভারতে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর হলো না। আমি আর্থারাইটিসের রোগী। আমার সব আঙুল বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আমার স্বামী হার্টের রোগী। রিফাত মারা যাওয়ার পর আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার কারণে আমাদের উপার্জনে চরম ব্যাঘাত ঘটেছে। যার কারণে আমাদের চিকিৎসাও হচ্ছে না।

এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমাদের মেয়েটাকে যদি তিনি (প্রধানমন্ত্রী) একটি চাকরি দিতেন, তাহলে আমাদের ভালো চলতো। অন্তত আমাদের চিকিৎসাটা চলতো।

এ বিষয়ে নিহত রিফাতের একমাত্র বোন ইসরাত জাহান মৌ বলেন, জীবনে এই প্রথম আমার ভাইয়াকে ছাড়া একটি বছর কেটেছে আমার। এই এক বছর ধরেই তিলে তিলে অনুভব করেছি- আপন মানুষ বা প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট এবং যন্ত্রণা হৃদয়ে কতটা ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। আমার বাবা-মা তাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে কতটা দুঃখ এবং ভারাক্রান্ত মনে দিন কাটাচ্ছে, তাও খুব কাছ থেকে দেখছি। আমার একটাই আবেদন- আমরা যেন ন্যায় বিচার পাই। আমরা শুধু এটাই চাই।

এ বিষয়ে রিফাতের শ্বশুর মো. মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, আমি রিফাতের রুহের মাগফেরাত কামনা করি এবং সকলের কাছে রিফাতের জন্য দোয়া চাই।

রিফাতের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হওয়ায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, রিফাতকে আমি তিনমাস আমার ছেলের মতোই লালন-পালন করেছি। কুচক্রি মহলের কারণে রিফাত নিহত হলো এবং রিফাতকে বাঁচানোর জন্য মিন্নি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করলো, তা সবই বিফলে গেল।

প্রভাবশালী মহলের স্বার্থে মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে মিন্নিকে আসামি করা হয়েছে জানিয়ে মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, এ মামলায় তিনি ন্যায় বিচার পাবেন। মিন্নি এ মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পাবেই।

এ মামলার এখনও পলাতক এক আসামিকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. শাহজাহান হোসেন বলেন, এ মামলার পলাতক আসামি মুসা বন্ডকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে জেলা নারী ও শিশু আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল বলেন, রিফাত হত্যা মামলা দেশের বহুল আলোচিত মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ মামলার রায়ের অপেক্ষা করছে পুরো দেশবাসী।

তিনি বলেন, জেলা নারী ও শিশু আদালতে বিচারাধীন এ মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির মধ্যে সাতজন জামিনে আছে। এছাড়াও এই মামলার ৭৫ জন সাক্ষীর মধ্যে ৭৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি আছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে আদালতের কার্যক্রম সীমিত আকারে পরিচালিত হওয়ার কারণে মামলার বিচার কার্যক্রম এখন বন্ধ আছে।

Minni-Rifat2.jpg

দেশে করোনার প্রভাব না থাকলে এতোদিনে এ মামলার রায় ঘোষণা সম্পন্ন হতো জানিয়ে তিনি বলেন, আদালতের কার্যক্রম স্বাভাবিক হলে এ মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হতে বেশি সময় লাগবে না।

এ বিষয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ভূবন চন্দ্র হালদার বলেন, জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আর মাত্র তিন-চারটি কার্যদিবস পেলেই প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মামলার রায় ঘোষণা হবে।

রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক আসামিরা হলেন- রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি, আল কাইউম ওরফে রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান, মো. মুসা, আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি, রাফিউল ইসলাম রাব্বি, মো. সাগর এবং কামরুল ইসলাম সাইমুন।

অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামিরা হলেন- মো. রাশিদুল হাসান রিশান ফরাজী, মো. রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার, মো. আবু আবদুল্লাহ রায়হান, মো. ওলিউল্লাহ অলি, জয় চন্দ্র সরকার চন্দন, মো. নাইম, মো. তানভীর হোসেন, নাজমুল হাসান, রাকিবুল হাসান নিয়ামত, মো. সাইয়েদ মারুফ বিল্লাহ মহিবুল্লাহ, মারুফ মল্লিক, প্রিন্স মোল্লা, রাতুল সিকদার জয় এবং আরিয়ান হোসেন শ্রাবণ।

বৈশাখী নিউজজেপা