বাংলাদেশকে নিয়ে পাকিস্তান এখন কেন এত আগ্রহী?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত বুধবার (২২ জুলাই) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের টেলিফোন এবং তাদের মধ্যে ২০ মিনিটের আলাপ এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির একটি অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।
বিশেষ করে গত পাঁচ বছর যাবত বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিলো, আর এর বিপরীতে দেশটির চিরশত্রু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়েছে যে ইমরান খান ও শেখ হাসিনার মধ্যকার ফোনালাপ অনেকের মনেই বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। এক বিশেষ প্রতিবেদনে এসব বিষয়ে আলোকপাত করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি।
পাকিস্তানের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক দ্য নেশন তাদের এক প্রতিবেদনে ইমরান খান ও শেখ হাসিনার টেলিফোন আলাপকে “ডন অব আ নিউ এরা” অর্থাৎ পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কে “নতুন দিগন্তের সূচনা” হিসাবে বর্ণনা করেছে। প্রভাবশালী এই পত্রিকাটি বলছে, বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য পাকিস্তানের এখন সম্ভাব্য সবকিছু করা উচিৎ।
তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, যে পাকিস্তান বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে ২০১৬ সালে তাদের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব পর্যন্ত পাস করেছে, তারা কেন বাংলাদেশের নৈকট্যের জন্য এখন এত বেশি উদগ্রীব?
আর যে আওয়ামী লীগ সরকার গত প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকায় পাকিস্তানের একজন হাইকমিশনারের নিয়োগ ঝুলিয়ে রেখেছিল, তারা ভারত মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারে জেনেও বুধবারের ওই ফোনালাপে কেনইবা সায় দিলো?
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পাঞ্জাব প্রদেশের সাবেক অস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী হাসান আসকারি রিজভি বিবিসি’কে বলেন, ইমরান খান ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী।
তিনি বলেন, “বিভিন্ন সময়ে সেই বার্তা তিনি শেখ হাসিনাকে দিয়েছেন কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাতে সাড়া দেননি। এখন মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা হয়ত মত বদলেছেন।“
তিনি বলেন, ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক এতটাই খারাপ হয়ে পড়েছে যে পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছে।
পাকিস্তানের এক্সপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকার কামরান ইউসুফ লিখছেন – ইমরান খান ও শেখ হাসিনার মধ্যে ফোনালাপ অনেকের কাছে হঠাৎ মনে হলেও “নীরব কূটনীতির” মধ্য দিয়ে এর প্রস্তুতি চলছে গত কয়েকমাস ধরে।
প্রায় ২০ মাস ঢাকায় পাকিস্তানের একজন নতুন হাই কমিশনারের নিয়োগের অনুমোদন ঝুলিয়ে রাখার গত নভেম্বরে বাংলাদেশ সরকার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকীর নিয়োগ অনুমোদন করে।
এরপর জানুয়ারিতে ঢাকায় দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রদূত সিদ্দিকী ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্কে তিক্ততা দূর করার চেষ্টা শুরু করেন।
পহেলা জুলাই ঢাকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সাথে এক বৈঠক করেন। পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এক্সপ্রেস ট্রিবিউন বলছে, ওই বৈঠকের পর থেকে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সরাসরি কথা বলার সিদ্ধান্ত হয়।
দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কে শীতলতা
পাকিস্তানের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে মোদী সরকারের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের সম্পর্কে একটা সঙ্কট তৈরি হয়েছে। একারণে পাকিস্তান মনে করছে বাংলাদেশকে কাছে আনার চেষ্টার জন্য এটা একটি সুযোগ।
হাসান আসকারি রিজভি বলছেন, ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন ও আসামে এনআরসির কারণে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক চাপে পড়েছে।
তিনি বলেন, “আসামে যে কয়েক লাখ মানুষ নাগরিকত্ব হারিয়েছে, ভারত বলছে তারা বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশ এটা ভালোভাবে নেয়নি। ভারতে পরিস্থিতির কারণেই খুব সম্ভবত ইমরান খান সরকারের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ হয়তো এখন কথা বলতে রাজি হতে পারে।”
তবে, দি নেশন তাদের এক উপ-সম্পাদকীয়তে লিখেছে, আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির চরিত্র যেভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে তাতে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে উভয় দেশই কাছাকাছি আসার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে।
দি নেশনের মতে, “ চীন ও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এশিয়ায় জোটবদ্ধ রাজনীতি-অর্থনীতির প্রধান ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক নতুন এই বাস্তবতা থেকে লাভবান হতে পারে।”
তবে, ১৯৭১ এর গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া বা সম্পদের বাটোয়ারার মত যেসব ইস্যু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের মূলে রয়েছে সেসব নিয়ে পাকিস্তান কতটা নমনীয় হতে পারে?
এপ্রসঙ্গে হাসান আসকারি রিজভি বলেন, “পাকিস্তান এই মুহূর্তে নতুন করে ১৯৭১ এর খাতা খুলতে আগ্রহী হবে না। পাকিস্তান যেটা বলতে চায় তা হলো অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করে চলুন সামনের দিকে এগোই।”
তার মতে, ইতিহাসের বাস্তবতায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কে জটিলতা দূর করা সহজ নয়। ইমরান খান ও শেখ হাসিনার মধ্যে টেলিফোন আলাপ সম্পর্কের নতুন দিগন্তের সূচনা নয়। তবে অবশ্যই একটি “ইতিবাচক অগ্রগতি”।
বৈশাখী নিউজ/ ইডি