টিকা যাচ্ছে গ্রামে গ্রামে ৭ আগস্ট থেকে

করোনার টিকা দেওয়ায় গতি বাড়ছে আগামী ৭ আগস্ট থেকে। দিনে সাড়ে আট লাখ করে প্রতি সপ্তাহে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এ জন্য দেশে বিদ্যমান সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) কার্যকর করা হবে কভিড টিকার ক্ষেত্রেও।

গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্য অস্থায়ী টিকাদানকেন্দ্রগুলোকেও কাজে লাগানো হবে। স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরাও টিকাদান কার্যক্রমে অংশ নেবেন।

প্রয়োজনে অতি বয়স্ক এবং যাঁরা চলাফেরা করতে পারেন না, তাঁদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধনপ্রক্রিয়া আরো সহজতর হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে এসব কেন্দ্রে হাজির হলেই পাওয়া যাবে টিকা। এরই মধ্যে এ জন্য মাঠ পর্যায়ে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে।

কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সারা দেশে। পাশাপাশি কভিড টিকা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় কর্মকর্তারাও বেরিয়ে পড়েছেন মাঠের প্রস্তুতি দেখতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মাঠ পর্যায়ে টিকাদান কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এদিকে টিকা দেশে আসা এবং টিকা দেওয়ায় গতি বাড়াতে এসব পরিকল্পনা সাজানো হলেও এখন পর্যন্ত যাঁরা নিবন্ধন করেছেন, তাঁদের বড় একটি অংশ টিকা দেওয়ার দিনক্ষণ জানতে না পারায় তাঁদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, দু-তিন সপ্তাহ আগে নিবন্ধন করেও এখনো টিকার দিনক্ষণের এসএমএস পাননি। তবে নীতিনির্ধারকরা বলছেন, প্রবাসীদের অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে কিছু কেন্দ্রে অন্যদের টিকার তারিখ পেতে দেরি হচ্ছে। দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।

তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এ দফায় গত ৭ জুলাই থেকে দেশে কভিড টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন শুরু হওয়ার পর থেকে গতকাল সোমবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ৭৪৮ জন। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত টিকা নিতে পেরেছেন ১৬ লাখ ৫২ হাজার ১০ জন বা ৩১.৮৬ শতাংশ।

আর দেশে এ পর্যন্ত মোট (গতকাল বিকেল পর্যন্ত) নিবন্ধন হয়েছে এক কোটি ২৬ লাখ ১২ হাজার ৪৪৭ জনের, যাঁদের মধ্যে মোট টিকা পেয়েছেন (প্রথম ডোজ) ৭৭ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩০ জন (৭০ শতাংশ)।

প্রথম ডোজ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্য থেকে এ পর্যন্ত মোট দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন হয়েছে ৪৩ লাখ ১০ হাজার ৪৪৩ জনের। এ ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নেওয়া ১৫ লাখ ২১ হাজার ৯২৯ জন ওই টিকার দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন।

গতকাল এক দিনে টিকা নিয়েছেন প্রথম ডোজ হিসেবে দুই লাখ ১৭ হাজার ৫৮ জন ও দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন চার হাজার ৪৭৮ জন। সব মিলিয়ে গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট এক কোটি ২০ লাখ ৮৭ হাজার ৮৭৩ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে কভিড টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সমন্বয়কারী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সোমবার (২৬ জুলাই) গতকাল বলেন, ‘আমরা প্রতি সপ্তাহে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি।

লকডাউন শেষে হলেই আশা করছি আগামী ৭ আগস্ট থেকে ওই পরিকল্পনা অনুসারে বিশেষ ক্যাম্পেইন আকারে মাঠ পর্যায়ে টিকা দেওয়া শুরু হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে যখন যে এলাকায় শিডিউল থাকবে সেই এলাকার ১৮ ঊর্ধ্ব সবাইকে টিকা দেওয়া শেষ করে অন্য এলাকায় যাওয়া হবে, যাতে সেখানকার কেউ টিকা ছাড়া না থাকে।

এ ক্ষেত্রে ওই এলাকার সবাই টিকার আওতায় এসে যাবে। এ জন্য ওই এলাকায় আগে প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কেন্দ্রে এলেই টিকা দেওয়া হবে। টিকাদানকর্মীরা শিথিল পন্থায় নিবন্ধনের কাজটি সেরে নেবেন।’

এদিকে গত দু-তিন সপ্তাহ আগে টিকার জন্য নিবন্ধন করেও এখনো যাঁরা এসএমএস পাননি, তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও পড়েছে চাপের মুখে। নিবন্ধনকারীরা নানাভাবে তাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। প্রতিদিন অনেকেই ভিড় করছেন বিভিন্ন হাসপাতালে।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে টিকা নেওয়ার জন্য গত ৮ জুলাই সুরক্ষা অ্যাপসের মাধ্যমে নিবন্ধন করেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ফাতেমা আক্তার। গতকাল পর্যন্ত তিনি কোনো এসএসএম পাননি। ক্ষুব্ধ ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘নিবন্ধন করে ১৮ দিনেও যদি এসএমএস না পাই তবে টিকার প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকবে কিভাবে! এটা তো খুবই অব্যবস্থাপনার নজির।

যদি ওই কেন্দ্রে চাপ বেশি থাকে তবে আমাদের অন্য কেন্দ্রে পাঠানো হোক কিংবা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করে টিকা দেওয়া হোক; তাহলে তো স্বস্তি পাই।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘প্রবাসী আর অন্যদের টিকা একই কেন্দ্রে না রেখে প্রয়োজনে আলাদা ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেমনটা করা হচ্ছে কভিড টেস্টের ক্ষেত্রে।

বিভিন্ন স্টেডিয়াম বা বড় অডিটরিয়ামগুলো এসব কাজে ব্যবহার করা যায় সহজেই। চাইলে দু-এক দিনের মধ্যেই সব প্রবাসীর টিকা দেওয়া শেষ করা সম্ভব। কিন্তু কেন সেটা করা হচ্ছে না তা আমরাও বুঝতে পারছি না।’

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমার এখানে প্রায় ২০ হাজার নিবন্ধন করা আছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী কর্মীদের অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে।

আমাদের সেন্টারে দিনে এক হাজার ২০০ প্রবাসী কর্মী ও ১০০ জন অন্য মানুষকে টিকা দিতে পারছি। ফলে এ ধরনের জট লেগে গেছে। প্রবাসী কর্মীদের টিকা দেওয়া শেষ হলে অন্যদের জট কেটে যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে হয়তো আরো পাঁচ-সাত দিন এই সমস্যা থাকবে।’

এ বিষয়ে ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘ঢাকায় সাতটি কেন্দ্রে প্রবাসী কর্মীদের ভিড় বেশি থাকায় এই কেন্দ্রগুলোতে অন্য নিবন্ধনকারীদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে।

আমরা এ সমস্যা কমাতে এই হাসপাতালগুলোতে বুথ বাড়ানোর চেষ্টা করছি, যাতে মানুষের অপেক্ষার পালা কমিয়ে আনা যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় বসবাসকারী অনেকে নিজ নিজ এলাকা রেখে ঢাকায় এসে টিকা দিতে নিবন্ধন করছেন এবং ভিড় করছেন। এতে সমস্যা আরো বেড়েছে। সবাই যদি যার যার এলাকায় টিকা দিতেন তবে ঢাকায় চাপ কমত।’

এদিকে জট কমানোর জন্য যেসব কেন্দ্রে বেশি নিবন্ধনকারী রয়েছেন, তাঁদের তুলনামূলক কম চাপ আছে এমন সব কেন্দ্রে টিকা দেওয়ার সুযোগ রাখা বা কেন্দ্র পরিবর্তনের জন্য অনেকে পরামর্শ দিচ্ছেন।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘কেন্দ্র পরিবর্তনের সুযোগ আগে ছিল। তখন নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল বলেই এটা বন্ধ করা হয়েছে। কেন্দ্র পরিবর্তন করলে অনেক ধরনের কারিগরি বিশৃঙ্খলা দেখা যায়; পক্ষান্তরে যা আবার সেই টিকাগ্রহীতাদের ভোগান্তিরও কারণ হয়। বরং সবাই যদি কিছুটা ধৈর্য ধরেন তবে দ্রুত সময়ের মধ্যেই টিকা পেয়ে যাবেন।’

অন্যদিকে হাতে যখন যে টিকা থাকে তা দ্রুত মানুষকে দিয়ে দেওয়ার জন্য দিনে আট-দশ লাখের বেশি টিকা দেওয়া যায় কি না এমন প্রশ্নে ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘টিকা দেশে আসার ক্ষেত্রে আগের তুলনায় গতি বেড়েছে সেটা ঠিক, কিন্তু যা আসছে সেটা তো আরেক হিসাবে খুব বেশি নয়। এক দিনে অনেক বেশি টিকা দিয়ে ফেলার মতো অবস্থায় এখনো আমরা আসিনি।’

তিনি বলেন, ফ্রন্টলাইনারদের সন্তানদের মধ্যে যাঁদের বয়স ১৮ বছরের ওপরে, তাঁদের টিকা দেওয়ার বিষয়টিতে কিছুটা জটিলতা আছে। তাঁদের আলাদা করে শনাক্ত করার প্রক্রিয়া কিছুটা সময়সাপেক্ষ।

এ জন্যই এখনো তাঁদের নিবন্ধন করা যাচ্ছে না। এটা কিভাবে সহজ করা যায়, সেটা ভাবা হচ্ছে। তবে ক্যাম্পেইনের আওতায় যখন প্রতিটি এলাকায় টিকা দেওয়া হবে, তখন এমনিতেই ১৮ বছরের ওপরের সবাই টিকা পেয়ে যাবেন।

এদিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নেওয়া যে ১৫ লাখ ২১ হাজার ৯২৯ জন দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন, তাঁদের জন্য কিছুটা হলেও সুখবর মিলছে।

এই টিকার জোগান বিলম্বিত হওয়ায় সরকার এত দিন তা দিতে না পারলেও দুই দিন আগে জাপান থেকে দুই লাখ ৪৫ হাজার ২০০ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেশে এসেছে; দু-এক দিনের মধ্যে যা দিয়ে আবারও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বৈশাখী নিউজ/ বিসি