বাঁশখালী হানাদার মুক্ত দিবস আজ

১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের বাঁশখালী পাক হানাদার মুক্ত হয় ১২ ডিসেম্বর। চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ৪ দিন আগে বাঁশখালীতে পাক–হানাদারদের রুখে দিয়ে ১ম বারের মত স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিকামী জনতা। এর মধ্যে দিয়ে বিজয়ের স্বাদ পায় বাঁশখালীবাসী। যুদ্ধকালীন বিভিন্ন সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাঁশখালীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে অভিযান চালিয়ে শত্রুমুক্ত করে।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, বাঁশখালীতে চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। এই চারটি গ্রুপের হয়ে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা মৌলভি ছৈয়দ ও সাবেক সাংসদ সুলতান উল কবির চৌধুরী, শফিকুর রহমান, ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী ও ছমিউদ্দিন। এর মধ্যে শফিকুর রহমানের গ্রুপে ৩৫ জন, মৌলভি ছৈয়দ ও সুলতান উল কবির চৌধুরী গ্রুপে ৬৫ জন, ডা. আবু ইউসুফ চৌধুরী গ্রুপে ১২ জন এবং ছমিউদ্দিনের গ্রুপে ৩০জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
সেইদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চট্টগ্রাম জেলার সহ কমান্ডার (অর্থ) মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘যতই দেশের বিজয় ঘনিয়ে আসছিল ততই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রাজকাররা তাবু গুটিয়ে একজায়গায় একত্রিত হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা গুণাগরির ওয়াপদা বিল্ডিংয়ে ঘাঁটি গাড়ে। এই ঘাঁটিতে ২৫০ থেকে ৩০০জন রাজাকার ছিল।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি গ্রুপ একত্রিত হয়ে ১৯৭১ এর ১০ ডিসেম্বর রাজাকারদের ঘাঁটি ওয়াপদা বিল্ডিং এ অ্যাকশন শুরু করে। গোলাগুলির মধ্যে বেশ কিছু রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ চলে টানা দুইদিন। অবশেষে ১২ডিসেম্বর সকালে ৭৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এরপর ওয়াপদা বিল্ডিংয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধারাসহ মুক্তিকামী জনতা একত্রিত হয়ে মিছিল সহকারে বর্তমানে বাঁশখালী থানা এলাকায় পতাকা উত্তোলন করেন। এর মধ্যে দিয়েই মূলত হানাদারমুক্ত হয় এই উপজেলা।
১৯৭১ সালের ১৯ মে পাক হানাদার বাহিনী বাঁশখালীতে প্রথম অভিযান চালায়। এই দিন সকাল ১০টার দিকে বাঁশখালীর পূর্বাঞ্চল এবং হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় পাক হানাদার বাহিনী বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রভাবশালী স্বাধীনতা বিরোধীরাসহ শতাধিক সৈনিক ও ১০ ট্রাক সাজোয়া বহর নিয়ে বাণীগ্রাম থেকে শুরু করে নাপোড়া পর্যন্ত চালায় ইতিহাসের জগন্যতম বর্বর, নির্বিচার গণহত্যা ও বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ। তাদের হিংস্রতায় বাঁশখালীর বিভিন্ন গ্রামে ৯০ জন সংখ্যালঘু নারী–পুরুষকে হত্যা করা হয়।
নিজ এলাকা ও দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন বাঁশখালীর আরও ১০ জন বীর সেনানী। এইসব শহীদদের মধ্যে কালীপুর ইউনিয়নের ১৮ জনকে হাত–পা বেঁধে আধমরা অবস্থায় বাঁশখালী ডিগ্রী কলেজের দক্ষিণ পার্শ্বে গর্তে ফেলে নির্মমভাবে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। এ বধ্যভূমিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রুপ কমান্ডার খোন্দকার মোহাম্মদ ছমিউদ্দীনের উদ্যোগে ১৫ মার্চ ১৯৮৯ তারিখে একটি গণসমাধি ভিত্তিস্থাপন করা হয়। ২৬ মার্চ ১৯৮৯ তারিখে এই গণসমাধির ফলক উন্মোচন করেন বাঁশখালীর তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান সুজিত কান্তি সিকদার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জালাল আহমদ।
বাণীগ্রামে নিহত ২২ জনকে রাতের অন্ধকারে বাণীগ্রাম মধ্য পাড়া পুকুর পাড়ে স্থানীয়দের সহযোগিতায় সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে এই শহীদের স্মরণে ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নাম ফলক সম্বলিত স্মৃতিস্তম্ভ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এমএফ কমান্ডার ও সাধনপুর ইউপি চেয়ারম্যান খোন্দকার মোহাম্মদ ছমিউদ্দীন। ২০১২ সালের ২৬ মার্চ এই স্মৃতিস্তম্ভ ফলক উন্মোচন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক।
বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও সাধনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কে এম সালাহ্উদ্দীন কামাল বলেন, বধ্যভূমি ২টি সংরক্ষণে আমি জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেছিলাম তারই প্রেক্ষিতে সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবে ও শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।
বাঁশখালীর সাংসদ আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সকল ধরনের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তারই প্রেক্ষিতে বাঁশখালীর সকল মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের সকল সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি বধ্যভূমিগুলো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে দৃষ্টিনন্দন বধ্যভূমি নির্মাণের জন্য সকল ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।