মে মাস পর্যন্ত ৫৪ মন্ত্রণালয়ে ১২৯টি সংস্কার সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে: প্রধান উপদেষ্টা

আপডেট: June 7, 2025 |
inbound5517703192603948205
print news

সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনার মধ্যে অর্থনীতিসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্কার পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ৫৪টি মন্ত্রণালয়ে ১২৯টি সুপারিশ ‘বাস্তবায়ন’ করা হয়েছে। দেশের মানুষকে বিগত সরকারের ‘লুটপাটতন্ত্র’ থেকে বের করে আনার ‘সর্বোচ্চ’ চেষ্টার পাশাপাশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থার বাড়ানোর গুরুত্বের বিষয়টিও এসেছে জাতি উদ্দেশে দেওয়া তার ভাষণে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় ৭টায় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে দেওয়ার প্রায় ৪০ মিনিটের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “অর্থনীতিসহ বিগত মাসগুলোতে সরকারের প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় ছোটবড় বহু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। মোট ৫৪টি মন্ত্রণালয়ে ১০৬১টি সংস্কার ও উন্নয়ন সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

“এর পাশাপাশি আমরা যে সংস্কার কমিশন করেছিলাম তাদের সুপারিশের মধ্য থেকে আশু করণীয় সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করে যাচ্ছে। মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে ৫৪টি মন্ত্রণালয়ে ১২৯টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।”

গত ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। অক্টোবরে প্রথম ধাপে গঠিত সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। পুলিশ বাদে বাকি পাঁচ কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে ঐকমত্য গঠনে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন করা হয়, যা ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে।

বিভিন্ন সংস্কার সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছানো ও ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা এ ঐকমত্য কমিশনের লক্ষ্য।

১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করা এ কমিশনকে ছয় মাস সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এরপর ৫ মার্চ পাঁচটি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে তাদের মতামতের জন্য পাঠানো হয়।

এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ ছিল ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সুপারিশ ছিল ২০টি। প্রথম দফায় ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের ৪৫টি অধিবেশন হয়। আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকটি দলের সঙ্গে একাধিক দিনও বৈঠক চলে।

তবে সংস্কার নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমালোচনা রয়েছে। তারা বলছে, সংস্কার নিয়ে কালক্ষেপণ করছে সরকার। জরুরি সংস্কার করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিও তুলেছে তারা। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা যে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন সেগুলোর মধ্যে কয়েকটির চুম্বক অংশ তুলে ধরেন।

এতদিন প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের ধারণা দিয়ে আসছিলেন। তবে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন পক্ষের চাপের মধ্যে আগের ঘোষণা থেকে কিছুটা এগিয়ে এনে ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের কথা বলেছেন তার ভাষণে।

সংস্কারের ফিরিস্তি তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “আইন ও বিচার বিভাগ মোট ৩৩টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুনালস) অ্যাক্ট ১৯৭৩ সংশোধন ও পুর্নগঠন করে আইনটি আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা।”

বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ ২০২৫ প্রণয়ন ও জারি করার কথা তুলে ধরে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “এর অধীনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।”

দেওয়ানি কার্যবিধির সংশোধন করার বিষয়ে তিনি বলেন, “এর ফলে এখন বাদীকে আর দিনের পর দিন সশরীরে আদালতে যেতে হবে না। একেকটি দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হতে আগে যত সময় লাগত এই সংশোধনীর ফলে সময়সীমা অর্ধেকে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করছি।”

তিনি বলেন, “দেশের এক হাজারের বেশি অবকাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানের নাম পলাতক প্রধানমন্ত্রীর বাবা-মা-ভাই-বোন-আত্মীয়স্বজনের নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল সেনানিবাস, বিমানঘাঁটি, নৌ-বাহিনীর জাহাজ, মেগাসেতু, সড়ক, স্থাপনা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, গবেষণাকেন্দ্র- আরও বহু কিছু। এগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।”

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ও ‘পাওয়ার অব অ্যার্টনি’ বিধিমালা সংশোধন করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখন পুরোনো পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড স্টিকার’ থাকলে কিংবা জন্মসনদ থাকলে বিদেশ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে পারবে। আগামী দুই মাসের মধ্যে আইনগত সহায়তা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিস্তার করা হবে।

“বছরে এখন গড়ে ৩৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়, আমাদের লক্ষ্য এটিকে ২ লক্ষ মামলায় উন্নীত করা। মামলা দায়েরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই যাদের বিরুদ্ধে মামলার কোনো ভিত্তি নেই তাদের বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”

দেশের মানুষকে ‘লুটপাটতন্ত্র’ থেকে বের করে আনতে অন্তর্বর্তী সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে দাবি করে ইউনূস বলেন, “আপনারা জানেন, বিগত ১৬ বছরে উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্প নিয়ে কী পরিমাণ লুটপাট হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলো যেন হয়ে উঠেছিল মেগা ডাকাতির প্রকল্প।” অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প পুনরায় মূল্যায়ন করা হয়েছে তুলে ধরে তিনি বলেন, “প্রায় সব প্রকল্পেই ভৌতিক ব্যয় ধরা হয়েছে।

“শুধুমাত্র সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ, রেল মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ—এই পাঁচ বিভাগেই ব্যয় সংকোচন করা হয়েছে ৪৬ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা।”

“এই টাকা দিয়ে জ্বালানি খাতে সমস্ত বকেয়া মিটিয়ে দিয়ে বকেয়ার পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছে।” প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে সব ধরনের ঋণের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা সরকারের অগ্রাধিকার। “দেশে বিনিয়োগ বাড়ানো ও নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে আমাদের গুরুত্ব দিতেই হবে। তা না হলে এদেশকে আমরা যে স্থানে নিয়ে যেতে চাই সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।”

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ব্যাপারে রাজনৈতিক দল ও জনগণও অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘সর্বাত্মক সমর্থন’ করছেন দাবি করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সকলের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ, কৌতূহল আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। “সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে ৩০টি মূল সংস্কারকাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই ১৮টি সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে।”

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে এবং দেশি-বিদেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করতে তাদের ‘সর্বোচ্চ’ চেষ্টার কথা তুলে ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান বলেন, “গত অক্টোবর হতে মার্চ পর্যন্ত নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মোট ৭৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।”

এপ্রিলে হয়ে যাওয়া বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রসঙ্গ টেনে ইউনূস বলেন, সেখানে নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক সেশনের মাধ্যমে ব্যবসায়ী চেম্বার, ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের অন্যান্য অংশীদারদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। সম্মেলনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও আলোচনার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখার কথাও বলেছেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সম্প্রতি চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীর সে দেশের ১০০টি কোম্পানির প্রায় দেড়শ বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী নিয়ে বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গও এসেছে। খুব দ্রুতই বড় আকারের বিদেশি বিনিয়োগ দেখতে পাবেন, এমন আশার কথাও বলেছেন তিনি।

সম্প্রতি তার চীন, কাতার, জাপানসহ কয়েকটি দেশ সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “এসব সফরেও বিভিন্ন বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও অগ্রগতির কথা তুলে ধরেছি। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আরও বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি যাতে বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় সে চেষ্টা করেছি।

“বাংলাদেশে কাতারের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের লাখো লাখো ছেলে-মেয়েরা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। তাদের জন্য প্রযুক্তি শিক্ষা ও বিদেশি ভাষা শিক্ষা চালু করতে আমরা কাতার চ্যারিটির সাহায্য চেয়েছি।”

গত মাসে জাপান সফরে দেশটির কাছ থেকে বাজেট সহায়তা ও রেলপথ উন্নয়নের জন্য এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ ঘোষণা, তিনটি চুক্তিপত্র বিনিময়, দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে ছয়টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর সইয়ের কথাও বলেছেন সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের কর্মশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি এবং জাপানে তাদের কর্মসংস্থান সহজতর করার লক্ষ্যে জাপানের সঙ্গে আমরা দুটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছি। “জাপানের শ্রমিক সংকট রয়েছে। আমরা আগামী পাঁচ বছরে জাপানে এক লাখ কর্মী পাঠানোর চুক্তি সই করেছি। এর চাইতেও আরও বেশি শ্রমিক ক্রমাগতভাবে পাঠানোর আয়োজন করে এসেছি।”

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর