আলজাজিরার প্রতিবেদন :বাংলাদেশে ‘এক কিডনির গ্রাম’

আপডেট: July 4, 2025 |
inbound8531192686486899096
print news

বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রাম আজ পরিচিত ‘এক কিডনির গ্রাম’ নামে। গ্রামের শতাধিক মানুষ দারিদ্র্য, ঋণের চাপ কিংবা প্রতারণার শিকার হয়ে নিজের কিডনি বিক্রি করেছেন। এই ভয়াবহ বাস্তবতা উঠে এসেছে আল–জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।

৪৫ বছর বয়সী সফিরুদ্দিন ২০২৪ সালে নিজের একটি কিডনি ভারতের এক রোগীর কাছে বিক্রি করেন ৩ দশমিক ৫ লাখ টাকায়। সেই টাকায় বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করলেও এখন সেটি অর্ধসমাপ্ত, আর সফিরুদ্দিন কিডনি হারিয়ে অসুস্থ ও দুর্বল। বর্তমানে তিনি দিনমজুরের কাজ করেন এবং প্রতিনিয়ত ব্যথায় কাতরান।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দালালরা কিডনি বিক্রেতাদের মেডিকেল ভিসায় ভারতে পাঠায়। সেখানে ভুয়া আত্মীয়তার সম্পর্ক, নকল কাগজপত্র, এমনকি কখনও কখনও ভুয়া ডিএনএ রিপোর্ট তৈরি করে প্রতিস্থাপনের অনুমতি নেওয়া হয়। ভারতের আইনে কেবল নিকটাত্মীয়ের কিডনি গ্রহণ বৈধ হলেও, এই জালিয়াতির মাধ্যমে আইনি ফাঁকফোকর ব্যবহার করা হয়।

২০২৩ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথ–এর গবেষণায় বলা হয়, কালাই উপজেলায় প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একজন কিডনি বিক্রি করেছেন। বেশিরভাগই ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী পুরুষ, যারা মাদকাসক্তি, জুয়া বা নিছক অনটনের কারণে এই পথ বেছে নিয়েছেন।

মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ডব্লিউএইচও টাস্কফোর্স সদস্য মনির মোনিরুজ্জামান জানান, প্রতারণার কৌশল একই—নাম পরিবর্তন, ভুয়া নোটারি সার্টিফিকেট, আইডি কার্ড ও আত্মীয়তার প্রমাণ তৈরি। ঢাকার এক ভুক্তভোগী সাজল (ছদ্মনাম) জানান, ১০ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রির কথা থাকলেও তিনি পান মাত্র ৩ দশমিক ৫ লাখ টাকা। পরে তিনিও চক্রে যুক্ত হন, এবং পরে তা ছেড়ে এখন রাইডশেয়ার চালক হিসেবে জীবিকা চালান।

ভারতের হাসপাতালগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান অর্থের বিনিময়ে জেনে-শুনেই ভুয়া কাগজ গ্রহণ করে থাকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোনো সমন্বিত তথ্য বা ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনসুলার বিভাগের মহাপরিচালক শাহ মুহাম্মদ তানভির মনসুর।

বিশ্ব স্বাস্থ্য খাতে বছরে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে ভারত। বিদেশি রোগী আকর্ষণ করে এমন অনেক হাসপাতাল এই ব্যবসায় জড়িত বলেই ধারণা করছেন গবেষকেরা। যদিও ২০১৯ ও ২০২৪ সালে কিছু ডাক্তার ও চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এটি বিচ্ছিন্ন এবং প্রতিরোধে পর্যাপ্ত নয়।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, অনেকে জানাশোনা সত্ত্বেও বিক্রি করেন, তবে বেশিরভাগই প্রতারিত হন। অনেকেই বিক্রির চুক্তির অর্থ পর্যন্ত পান না।

অন্যদিকে, ভারতের কিডনি ওয়ারিয়ার্স ফাউন্ডেশনের প্রধান বাসুন্ধরা রঘুবংশ মনে করেন, অঙ্গ দান বন্ধ না হলেও একটি মানবিক কাঠামো জরুরি। বিক্রেতাদের জন্য স্বাস্থ্যপরীক্ষা, অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

এদিকে, সফিরুদ্দিন এখনো সেই স্বপ্নের ঘরটি শেষ করতে পারেননি। শরীর দুর্বল, চিকিৎসা নেই, পাশে কেউ নেই। তাঁর কথায়, তারা কিডনি নিলো আর আমাকে ফেলে চলে গেল।

সূত্র: ইত্তেফাক

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর