রাশিয়া কি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে?

আপডেট: March 17, 2022 |
print news

ইউক্রেনে হামলা শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানান, তিনি তার ‘ডিটারেন্ট ফোর্সেসকে’ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এই ‘ডিটারেন্ট ফোর্সেস’ বা ‘প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বাহিনী’ আর কিছুই নয়, রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার।

পুতিনের ওই ঘোষণার পরপরই বিশ্বজুড়ে ভয় বাড়তে শুরু করে; অনেকের আশঙ্কা, মস্কো হয়তো পুরোদস্তুর পারমাণবিক যুদ্ধে যাবে না, কিন্তু ‘ট্যাকটিকাল’ পারমাণবিক অস্ত্র তো ব্যবহার করতেই পারে। অবশ্য এখন পর্যন্ত তেমন নাটকীয় কিছু ঘটার সম্ভাবনা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

‘ট্যাকটিকাল’ পারমাণবিক অস্ত্র

এগুলো সাধারণত সেই পারমাণবিক অস্ত্র, যেগুলো স্বল্প দূরত্বে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটিই এই অস্ত্রগুলোকে ‘স্ট্র্যাটেজিক’ পারমাণবিক অস্ত্র থেকে আলাদা করেছে। ‘স্ট্র্যাটেজিক’ এই বোমা হচ্ছে সেগুলো, স্নায়ু যুদ্ধকালে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন চাইলে লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে যেগুলো প্রতিপক্ষের ভূখণ্ডে আঘাত হানতে পারতো। এদিকে ‘ট্যাকটিকাল’ তকমাধারীর মধ্যেও অনেক ধরনের অস্ত্র আছে, আছে ছোট ছোট বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রও যেগুলোকে ‘যুদ্ধক্ষেত্রেও’ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।

রাশিয়ার কাছে সেগুলো আছে?

ধারণা করা হয়, রাশিয়ার কাছে প্রায় হাজার দুয়েক ‘ট্যাকটিকাল’ পারমাণবিক অস্ত্র আছে; এগুলো বিস্ফোরক সরবরাহে ব্যবহৃত প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোতেও জুড়ে দেওয়া সম্ভব। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কামানের গোলা হিসেবেও এই ‘ট্যাকটিকাল’ অস্ত্রগুলো ছোড়া যাবে। এসব পারমাণবিক অস্ত্র বিমান বা নৌযান থেকেও মারা সম্ভব; সাবমেরিন লক্ষ্য করে ছোড়া টর্পেডো ও পানির নিচে বিফোরিত হতে সক্ষম বিস্ফোরকেও ব্যবহার করা যায়।

এই ওয়ারহেডগুলো এখন অস্ত্রাগারেই আছে বলে অনুমান বিশ্লেষকদের; এর অর্থ হচ্ছে সেগুলো মোতায়েন করা হয়নি এবং ছোড়ার জন্যও প্রস্তুত নয়। তবে রাশিয়া যুদ্ধের কোনো এক পর্যায়ে বড় ‘স্ট্র্যাটেজিক’ ক্ষেপণাস্ত্রের বদলে ছোট ‘ট্যাকটিকাল’ অস্ত্র ব্যবহারে ঝুঁকতেই পারে, এমন উদ্বেগও কম নয়।

এগুলো কতটুকু শক্তিধর?

নানান আকার ও শক্তির আলাদা আলাদা ‘ট্যাকটিকাল’ পারমাণবিক অস্ত্র আছে। এগুলো কতটা ক্ষতি করতে পারে তা নির্ভর করে ওয়ারহেডের আকার, ভূমির কত উপরে এটি বিস্ফোরিত হল- তা এবং আশপাশের পরিবেশের উপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমায় যে বোমাটি ফেলে, তার ওজন ছিল মাত্র ১৫ কিলোটন; তা-ই প্রায় এক লাখ ৪৬ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ‘স্ট্র্যাটেজিক’ অস্ত্রের ওজন ৮০০ কিলোটন বলে অনুমান বিশ্লেষকদের।

russia nuclear missile risk 160322 02

পুতিনের বক্তব্যে দুশ্চিন্তা কতখানি?

রুশ প্রেসিডেন্ট একাধিকবার তার পারমাণবিক অস্ত্রের উল্লেখ করেছেন- সম্ভবত এক ধরনের ভীতি তৈরি করতে। মার্কিন গোয়েন্দারাও পুতিনের কথাবার্তাকে পরমাণু যুদ্ধের পরিকল্পনা হিসেবে না দেখে দেখছেন পশ্চিমাদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে; তারা যেন ইউক্রেনে বেশি হস্তক্ষেপ না করে। তবে অনেকে আবার মনে করেন, সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও, কোনো এক পরিস্থিতিতে পুতিন হয়তো ইউক্রেনে ছোট ‘ট্যাকটিকাল’ অস্ত্র ব্যবহার করে অন্যদের পরখ করে দেখতে পারেন।

ন্যাটোর সঙ্গে সংঘাতের ক্ষেত্রে রাশিয়ার ‘উত্তেজনা প্রশমনের জন্যই উত্তজনা বাড়ানোর’ একটি তত্ত্বও আছে, ভাষ্য মার্কিন গোয়েন্দাদের। এই উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য নাটকীয় কিছু করা লাগতে পারে; যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে বা অন্য কোথাও ‘ট্যাকটিকাল’ অস্ত্রের ব্যবহার, কিংবা ব্যবহারের হুমকি দেয়া। এর উদ্দেশ্য মূলত প্রতিপক্ষকে আতঙ্কিত করা, যেন প্রতিপক্ষ পিছু হটে।

তবে পশ্চিমা বিশ্লেষকদের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে যে দুশ্চিন্তা, তা হল- পুতিন যদি দেখেন যে তিনি একা হয়ে পড়ছেন এবং ইউক্রেইনে তার কৌশল ব্যর্থ হচ্ছে, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতির বদল ঘটাতে বা পরাজয় এড়াতে ‘গেইম চেঞ্জার’ হিসেবে তিনি ‘ট্যাকটিকাল’ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেও বসতে পারেন। তবে তেমন কিছু হলে ইউক্রেইন এমনকী রাশিয়ারও পরিস্থিতিও খারাপ হয়ে যেতে পারে, সেটাও তাকে বিবেচনায় নিতে হবে।

ইউক্রেনে কী হলে পুতিন নিজেকে ‘বিজয়ী’ ধরে নেবেন, তার ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করছে বলে মনে করেন লন্ডনের কিংস কলেজের পরমাণু বিশেষজ্ঞ ড. হিদার উইলিয়ামস। “একটা সমস্যা হচ্ছে, পুতিন ইউক্রেইনে কী ধরনের বিজয় চান, তা স্পষ্ট নয়; ওই বিজয়ের ধারণার উপরই নির্ভর করছে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে কি করবে না, তা,” বলেছেন তিনি।

এমন কিছু কি পুতিনেরও পরাজয় নয়?

পুতিন ইউক্রেইনকে রাশিয়ার অংশ বলে দাবি করেছেন, তাই সেখানে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বেশ উদ্ভটই হবে। রাশিয়া ইউক্রেইনের গা ঘেঁষে অবস্থিত, তার মানে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ইউক্রেইনে পড়লে তার ক্ষতিকর প্রভাব রাশিয়ায়ও পড়তে পারে। যুদ্ধে এখন পর্যন্ত একবারই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, তাও অনেক দিন আগে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে। যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে ওই অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিল।

পুতিন কি এই ‘চল’ এবারই ভেঙে দেবেন? করবেন পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার?

বেশিরভাগই মনে করছেন, ইউক্রেইনে হামলা বা যুক্তরাজ্যে নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করলেও রুশ প্রেসিডেন্ট পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সাহস করতে যাবেন না। ড. উইলিয়ামসের মতে, রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার আরেকটা কারণ হতে পারে- চীন।

“রাশিয়া চীনের সহায়তার ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। আর চীন পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে ‘কখনোই প্রথমে ব্যবহার করা যাবে না’ এমন তত্ত্বে বিশ্বাসী। পুতিন যদি সত্যিই তা ব্যবহার করে বসেন, তাহলে চীনের পক্ষে তার পাশে দাঁড়ানো খুবই কঠিন হবে। তিনি (পুতিন) যদি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে তাকে হয়তো চীনকে হারাতে হতে পারে,” বলেছেন তিনি।

তাহলে কি পরমাণু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে?

‘ট্যাকটিকাল’ পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা সম্ভবত কেউই জানে না। পুতিন হয়তো কেবল উত্তেজনাই বাড়াতে চান, পুরোদস্তুর পরমাণু যুদ্ধ চান না। কিন্তু হিসাবে ভুল হওয়ার ঝুঁকিতো থেকেই যায়। তেমন কিছু হলে কোনো না কোনো উপায়ে ন্যাটোকে প্রতিক্রিয়া দেখানোর পথেও হাঁটতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা এখন পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছেন। তাদের তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমগুলো রাশিয়ার ‘ট্যাকটিকাল’ অস্ত্রগুলো অস্ত্রাগার থেকে বের হচ্ছে কিনা, কিংবা তাদের উৎক্ষেপণ কেন্দ্রগুলোর আচরণে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে কিনা- তার ওপর চোখ রাখছে। এখন পর্যন্ত অবশ্য তেমন কোনো পরিবর্তনই চোখে পড়েনি তাদের।

পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেলে যুক্তরাষ্ট্র বা নেটো তার পাল্টায় কী করে, তা অনুমান করাও শক্ত। তারা হয়তো উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে পুরোদস্তুর পরমাণু যুদ্ধ শুরুর ঝুঁকি নেবে না, কিন্তু কোনো না কোনোভাবে ঠিকই কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

হতে পারে, পাল্টা পারমাণবিক অস্ত্র না ছুড়ে তারা প্রচলিত যুদ্ধের পথেই হাঁটবে। তখন তার প্রত্যুত্তরে রাশিয়া কি বসে থাকবে? “আপনি যখন পরমাণু অস্ত্রের চৌকাঠ পেরিয়ে যাবেন, তারপর আর থামার পথ নেই। সেক্ষেত্রে বিশ্ব কেমন হতে পারে, আমার মনে হয় না কারও এমন কোনো ধারণা আছে,” বলেছেন ওয়াশিংটন ডিসির কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পেসের পরমাণু বিশেষজ্ঞ জেমস অ্যাকটন।

বৈশাখী নিউজ/ ইডি

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর