ভারত কি পারবে চীন-যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে যেতে?

একদিকে করোনার ভয়াল থাবা ও তার প্রভাব, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষে ভাগ হয়ে যাওয়া সমগ্র বিশ্ব। এ অবস্থায় ধারণা করা হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় রকমের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেক বিশ্লেষক ভারতকে নিয়ে আলাদা করে ভাবছেন। অনেকেই দাবি করছেন, সামনের বাজারে ভারত হবে সবচেয়ে শক্তিমান দেশ।

অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিটি যুদ্ধ ও মহামারি বদলে দিয়েছে বিশ্বের রূপরেখা, বদলে গেছে ক্ষমতার হাত, বদলেছে অর্থনৈতিক হালচাল। এসব জিনিসকে মাথায় রেখেই এবার ধারণা করা হচ্ছে বিশ্বের সুপারপাওয়ারদের মধ্যে বড় রকমের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।

বেশ আগে থেকেই কথা উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে টপকে যাবে চীন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রে চলছে ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি ও রুশ নিষেধাজ্ঞার প্রভাব। অন্যদিকে চীন এখনও করোনার থাবা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। এখন পর্যন্ত সাংহাইতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলছে। ‘জিরো কভিড পলিসিতে’ কমে এসেছে চীনের জিডিপি।

করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাংহাই ও অন্যান্য শহরে লকডাউন দিয়ে বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়েছে চীনের অর্থনীতি। চলতি বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে দেশটির অর্থনীতি ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে। পূর্ববর্তী তিন মাসের তুলনায় জুনে শেষ হওয়া তিন মাসের চীনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে।

এ অবস্থায় কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে ভারত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ওপর দিয়ে যাচ্ছে নিষেধাজ্ঞার ঝড়। সেই ঝড়ের প্রভাব পড়েছে ইউরোপেও। কিন্তু রাশিয়ার থেকে সস্তায় তেল কিনে, ইউরোপের সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়িয়ে, নতুন জোট গঠন করে নিজেদের অর্থনীতিকে পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে ভারত। এতে করেই বদলে যাচ্ছে ভারতের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চেহারা। ধারণা করা হচ্ছে মাঠে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারলে চীন-যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে বিশ্ববাজারে ভারত হয়ে উঠবে শীর্ষ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ।

তবে সবটা সুন্দরভাবে শেষ হবে কিংবা চলার পথ সহজ হবে এমনটা ভাবার কিছু নেই। বিশ্ব অর্থনীতির মুকুট নিজের মাথায় নিতে চাইলে ভারতকে সামলাতে হবে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ।

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি

সারা বিশ্বের অর্থনীতি এক মারাত্মক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দিননিপাত করছে। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে আশঙ্কাজনক ভাবে। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতির নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম, আবাসন ব্যয় ও অন্যান্য খরচ চালাতে দেশগুলোর জনসাধারণ হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় ভারতের প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি সামাল দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে সুস্থির রাখা।

এ ব্যাপারে শনিবার (১৬ জানুয়ারি) রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) জানিয়েছে, ভারত তার কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়িয়ে, কারখানাগুলোকে সচল রেখে ও সেবা দান স্বাভাবিকভাবে পরিচালন করে মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে।

মূলত দ্রব্যমূল্যের যাচ্ছে তাই অবস্থা ও সরবরাহ সংকটের কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি প্রকট আকার ধারণ করে। এক্ষেত্রে রিজার্ভ ব্যাংক এ দুটি ক্ষেত্রকে স্বাভাবিক রাখতে বেশি জোর দিচ্ছে। আরবিআই জানিয়েছে, ‘আমরা খারাপ সময় ও মূল্যস্ফীতির ভয়াবহ রূপ পেছনে ফেলে এসেছি। এখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়। আশা করছি বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি থেকে ভারতকে নিরাপত্তা দেয়া কঠিন কিছু হবে না।’

আরবিআইয়ের মতে, এটাই সুযোগ বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের একটি শক্তিশালী অবস্থান নেয়ার। দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত উল্লেখ করে আরবিআই বলে, ‘ভারত হবে বিশ্বের দ্রুততম অর্থনীতির দেশ।’

এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসা ও কাঁচামালের সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ায় সুদিনের অপেক্ষা করছে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিশালী এই দেশটি। মূলত কারখানা ও কৃষিকে সমৃদ্ধশালী করে ভারত বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছে।

ডলারে দাম বৃদ্ধি

রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের পর থেকে এখন পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মান কমেছে ২৬ বার। সবশেষ ১৩ জুলাই বাজারে এক ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির দাম দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৮১, যা সর্বকালের রেকর্ড।

ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতীয় মুদ্রা প্রায় চার শতাংশ অবমূল্যায়নের সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে আমেরিকার নতুন অর্থনৈতিক নীতির কারণে ডলারের সঙ্গে অন্যান্য বৈশ্বিক মুদ্রার দরের বড় পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।

ডলারের সঙ্গে টেক্কা দিতে ও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে ভারত চীন ও রাশিয়ার পথে হাঁটছে। বিশ্ববাজারে ডলারের বিপরীতে রুবল ও ইউয়ান যেভাবে নিজেদের অবস্থান বদলেছে ঠিক একইভাবে রুপিও নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের শীর্ষ ব্যাংক ঘোষণা করেছে, রুপির মাধ্যমেই যাতে আন্তর্জাতিক লেনদেন করা যায়, তেমন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। অর্থাৎ চীন, রাশিয়ার পর ভারতও ডলারকে পাশ কাটানোর নীতি গ্রহণ করেছে।

সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রুপির ব্যবহারসংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনা বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, বিশেষ করে রফতানিতে গতি আনতেই এ উদ্যোগ। ভারতের রফতানি বাণিজ্যসহ সার্বিক আন্তর্জাতিক ব্যবসা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে।

আরবিআই বলছে, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে যারা যুক্ত, তাদের মধ্যে ভারতীয় মুদ্রায় লেনদেনের ইচ্ছা কিছুদিন আগে থেকে দেখা যাচ্ছিল। সেটা মাথায় রেখেই এ নতুন ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফলে বর্তমান ব্যবস্থার পাশাপাশি ইনভয়েসিং, পেমেন্ট এবং আমদানি বা রফতানির সেটেলমেন্ট ভারতীয় মুদ্রার মাধ্যমে করা যাবে।

বেকারত্বের হার

ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা বেকারত্ব। করোনা পরবর্তী ভারতের চাকরির বাজার সত্যিই করুণ। ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন মানুষের দেশটিতে পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ নেই, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজ চালাচ্ছে হাতেগোনা কর্মী দিয়ে, দেশের অভ্যন্তরে নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ অপ্রতুল।

বর্তমানে ভারতে বেকারত্বের হার ৭-৮ শতাংশ। পাঁচ বছর আগেও দেশটিতে বেকারত্বের হার ছিল ৫ শতাংশ। দেশটির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনাসময়ের লকডাউনে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, বন্ধ হয়ে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এখন করোনার প্রকোপ অনেকটা কমে আসলেও তৈরি হয়নি নতুন করে কোনো চাকরির সুযোগ। বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক প্রতিষ্ঠানই বাজারে ফেরেনি। এতে করে সৃষ্টি হয়েছে কর্ম সংকট, বেড়েছে বেকারত্ব।

ছয় বছর আগেও ভারতে কর্মক্ষম মানুষের পরিমাণ ছিল ৪৬ শতাংশ। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে তা ২২ শতাংশ কম। জুন মাসের পরিসংখ্যান অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মক্ষম মানুষের পরিমাণ ৬২ দশমিক ২ শতাংশ।

ভারতে বেকারত্বের শাপে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত নারী ও যুবকরা। বারো বছর আগেও ২০১০ সালে যেখানে ১৯ শতাংশ নারী বেকার ছিল, ২০২০ সালে সে হার বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৬ শতাংশে। ভারতের বেঙ্গালুরের আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রোজা আব্রাহাম করোনার আগে ও পরে নারীদের চাকরির বাজারে অবস্থান নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি মোট ২০ হাজার নারীর ওপরে গবেষণা চালিয়ে দেখেন, করোনাসময়ে পুরুষের তুলনায় নারীদের চাকরি হারানোর পরিমাণ ছিল বেশি। অনেকেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরেও বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়ে নিজ কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি।

একই দশা ভারতের তরুণ ও যুবকদের। দেশটিতে যাদের বয়স ২০-২৪ বছর, জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ। চীনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, মে মাসের হিসাব অনুযায়ী দেশটিতে যাদের বয়স ১৬-২৪ বছর তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ।

দিন যত গড়াচ্ছে ভারতের চাকরি বাজারে তরুণ ও যুবকদের চাহিদা ততবেশি কমছে। ২০-২৪ বছর বয়সের ভারতীয়দের চাকরির হারের ওপরে জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ বয়সের বেকারত্বের হার ছিল ২৪ দশমিক ২ শতাংশ, এখন যা বেড়ে ৪০ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত যদি চলমান এসব চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে পারে তাহলে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে যেতে খুব বেশিদিন সময় লাগবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যেমনি করে অর্থনীতির সোনালি মুকুট ব্রিটেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চলে এসেছিল, তেমনি এবারের সংকটে অর্থনীতির সেই কাঙ্ক্ষিত মুকুট ভারতের শিরে শোভা পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

সূত্র: ব্লুমবার্গ, রয়টার্স, টাইমস অব ইন্ডিয়া

বৈশাখী নিউজ/ জেপা