কিশোরগঞ্জে চলন্ত বাসে নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার পর স্বর্ণলতা বাসের চালক ও হেলপারসহ ঘটনায় জড়িত আসামিরা এটিকে সড়ক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল।
বাসের ভেতর তানিয়াকে চালক ও হেলপারসহ তিনজনে পালাক্রমে ধর্ষণের পর তাকে ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। পরে এটিকে দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে বাসের দুই স্টাফকে দিয়ে তানিয়ার মরদেহ পাঠানো হয় কটিয়াদী উপজেলা হাসপাতালে।
রিমান্ডে থাকা স্বর্ণলতা বাসের চালক নূরুজ্জামান ও হেলপার লালন মিয়া পুলিশের কাছে এসব তথ্য প্রকাশ করেছেন।
আসামিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে শুক্রবার রাতে স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসটি আটক করে পুলিশ। বাসের ভেতরে রক্তের দাগ রয়েছে। এ ছাড়া তানিয়ার সঙ্গে থাকা কাপড়-চোপড়সহ অন্যান্য আলামত উদ্ধার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজিতপুর থানা পুলিশের একটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ জানিয়েছেন, রিমান্ডে থাকা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার মূল মোটিভ এবং কারা এ ঘটনায় জড়িত তা জানা গেছে। রিমান্ড শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময়ের আগেই আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে পারেন বলেও জানান তিনি।
তবে তদন্তের স্বার্থে বিস্তারিত জানানো সম্ভব নয় বলে জানান পুলিশ সুপার।
গত ৬ মে রাতে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার বাহেরচর গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশে স্বর্ণলতা পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন বাহেরচর গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে ঢাকার কল্যাণপুরে অবস্থিত ইবনেসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্টাফ নার্স শাহিনূর আক্তার তানিয়া।
বাড়ির কাছে হওয়ায় বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর বাসস্ট্যান্ডে তার নামার কথা ছিল। রাত ৮ টার দিকে কটিয়াদী থেকে পিরিজপুর যাওয়ার সময় বাসে অন্য কোনো যাত্রী ছিল না।
মেয়েটিকে একা বাসে পেয়ে বাসের চালক নূরুজ্জামান, হেলপার লালনসহ আরও একজন বাজিতপুর উপজেলার বিলপাড় গজারিয়া নামক স্থানে চলন্ত বাসে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে প্রথমে মুমূর্ষু অবস্থায় মেয়েটিকে বাসে করে পিরিজপুর বাজারের সততা ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকানে নেয়া হয়।
ওই ফার্মেসির মালিক মো. হাবিবুর রহমান জানান, তিনজন লোক মেয়েটিকে আমার ফার্মেসিতে নিয়ে আসে। বাস থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে বলে জানায়। মেয়েটি তখনও জীবিত ছিল। তার ঠোঁটসহ মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখে আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেই।
পুলিশের সূত্র জানায়, এ অবস্থায় তানিয়াকে আবার একই বাসে তুলে কটিয়াদীর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পথে বাসের ভেতর ড্রাইভার, হেলপারসহ অন্যরা তাকে গলায় ওড়না প্যাঁচিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর প্রথমে রাস্তার পাশে তাকে ফেলে রাখা হয়। ঘটনা অন্যদিকে প্রবাহিত করতে রাত পৌনে ১১টার দিকে বাসের দুই স্টাফ আলামিন ও আবদুল্লাহ আল মামুন একটি সিএনজি করে তানিয়াকে কটিয়াদী হাসপাতালে নিয়ে যায়। বলা হয় – অজ্ঞাত পরিচয়ের মেয়েটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তারের সন্দেহ হলে পুলিশে খবর দেয়া হয়। এ সময় কৌশলে পালিয়ে যায় আলামিন ও মামুন। পরে হাসপাতালের পাশ থেকে আটক করা হয় মামুনকে। ওই রাতেই কাপাসিয়া থেকে আটক করা হয় বাসচালক ও হেলপারকে।
গত ৭ মে তানিয়ার বাবা বাদী হয়ে বাজিতপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে চার জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে বাজিতপুর থানায় একটি মামলা করেন। পরদিন আটক ৫ আসামিকে ৮ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল মামুন। রিমান্ডে প্রথম দিকে আসামিরা উল্টা-পাল্টা তথ্য দিলেও পরে তারা মুখ খুলতে শুরু করেন।
এ দিকে রোববার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে বাজিতপুর যাচ্ছেন পুলিশের ঢাকা বিভাগের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লা আল মামুন। দুপুর দেড়টার দিকে কিশোরগঞ্জ পুলিশ অফিসে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন।
অপর দিকে তানিয়ার মৃতদেহের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তাকে ধর্ষণ শেষে হত্যার সুস্পষ্ট আলামত পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন, কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. হাবিবুর রহমান।
তিনি জানান, পালাক্রমে ধর্ষণের ফলে মেয়েটির যৌনাঙ্গ রক্তাক্ত ছিল। এ ছাড়া ভারী কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করায় তার মাথার পেছনের দিকে হাড় ভেঙে গেছে।
আজ রোববার কিশোরগঞ্জ ২৫৯ শয্যা হাসপাতাল থেকে তার কাছে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।