প্রথম বাঙ্গালি চিত্রশিল্পীর জন্মদিনে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করা হোক বাঙ্গালির অঙ্গিকার

আপডেট: December 30, 2023 |

কামরুল হাসান, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি: আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিংশ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত বাঙ্গালি চিত্রশিল্পী, পূর্ববঙ্গের প্রথম শিল্পীদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের বিদ্রোহী স্বনামধন্য চিত্রকর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের আজ ১০৯তম জন্মবার্ষিকী ও ১১০তম শুভ জন্মদিন।

”এখনতো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোনও ছবি হয়না।” ———— শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহের বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন (সরকারি নথিপত্রে জন্ম তারিখ ১৮ই নভেম্বর ১৯১৪)।

বাবার নাম তমিজউদ্দিন আহমেদ এবং মা জয়নাবুন্নেছা। বাবা ছিলেন পুলিশের সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর। জয়নুল আবেদিন ছিলেন পিতামাতার নয় সন্তানের মধ্যে সবার বড়।

ছোটবেলা থেকেই জয়নুল আবেদিনের ছবি আঁকার প্রতি জোক ছিল। তিনি ছোটবেলা থেকেই পাখি, পাখির বাসা, মাছ, গরু-ছাগল, ফল-ফুল বিভিন্ন ধরণের ছবি এঁকে মা বাবাকে দেখাতেন।

তিনি মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধুদের সাথে কলকাতায় গিয়েছিলেন কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। সেখান থেকে ঘুরে আসার পর সাধারণ পড়াশুনায় মন বসাতে পারছিলেন না কোনভাবেই।

তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের সাধারণ পড়ালেখার পাট চুকিয়ে মায়ের অনুসমর্থনে কলকাতায় চলে যান। মা ছেলের আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হওয়ার জন্য খরচ প্রদান করেন।

তিনি ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি কৃতিত্বের সাথে ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকা নিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের কন্যা জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জয়নুল আবেদিন তিন পুত্রের জনক। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সাইফুল আবেদিন (টুটুল) স্থপতি; দ্বিতীয় পুত্র খায়রুল আবেদিন (টুকুন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে এমএ এবং কনিষ্ঠ পুত্র মঈনুল আবেদিন (মিতু) প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পানি-সম্পদ প্রকৌশল বিদ্যায় স্নাতক।

১৯৩৮ সালে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পান। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো, তারপর জয়নুল আবেদীন পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন।

তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলের তাঁর চাকরিটি ছেড়ে ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত নর্মাল স্কুলে আর্ট শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

তাঁর শিল্পী হিসেবে খ্যাতি, অসাধারণ সাংগঠনিক মেধা, তৎকালীন শিল্পী সহকর্মী ও বন্ধুদের সহযোগিতা এবং কতিপয় বাঙালি সরকারি কর্মকর্তার সাহায্য ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়েই সম্ভব হয়েছিল ১৯৪৮ সালে এদেশের প্রথম আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠা।

তখন এর নাম ছিল ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস’। এই ইনস্টিটিউটকে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষরূপে। মাত্র দু’কামরার সেই ইনস্টিটিউটটিকে ১৯৫৬ সালের মধ্যেই তিনি এক অতি চমৎকার আধুনিক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করেন।

পরবর্তীকালে এটি পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় এবং স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।

( পরবর্তী সময়ে মহাবিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তরিত হয় এবং এর বর্তমান পরিচয় চারুকলা ইনস্টিটিউট নামে )।

১৯৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াস্থ ‘কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটি’র সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।

দীর্ঘ ছ’মাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে তিনি মাত্র ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
জন্মদিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চিত্রশিল্পীকে।

এই বিদ্রোহী চিত্রকর আজ আমাদের ইতিহাস ও অস্তিত্বের অংশ যিনি তুলির আঁছড়ে বাংলাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিশ্বমঞ্চে।

তাই আমরা প্রত্যেকেই রুচির দুর্ভিক্ষ কাটিয়ে সুরুচি ও মননের বিসর্জন না দিয়ে প্রথমে নিজেকে পরিবর্তন করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভালো পরিবেশ, সঠিক মেধার উত্তরণ ঘটিয়ে রূপান্তরিত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় শপথ নেই।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর