ময়মনসিংহের ত্রিশালে চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডারের মূল হোতা গ্রেফতার

আপডেট: May 23, 2024 |

কামরুল হাসান, ময়মনসিংহ প্রতিনিধিঃ ময়মনসিংহ জেলার ডিবি পুলিশের একটি চৌকশ টিম ত্রিশালে সংঘটিত ত্রিপল মার্ডারের মূল হোতা আলী হোসেনকে ২২ মে গাজীপুরের শ্রীপুর থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

ধৃত আসামী আলী হোসেনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক র্বণনা প্রদান করে।

আজ ২৩ মে দুপুর ২ টায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং এ সাংবাদিকদের বিষয়টি জানানো হয়।

ভিকটিমত্রয় আসামী আলী হোসেনের পরিবারের লোকজন। স্ত্রী ও তার দুই আদরের ছেলে সন্তান।

স্ত্রী আমেনা খাতুন (২৫), বড় ছেলের নাম আবু বক্কর সিদ্দিক (৪) ও ছোট ছেলে আনাছ (২ বছর ৬ মাস)। সে দীর্ঘদিন ধরে তার চাচার দেওয়া জমিতে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছে।

সংসারে সারা বছর অভাব অনটন লেগেই থাকত। অভাবের তাড়নায় ঠিকমত সংসার চালাতে পারত না। তাই সে পরিকল্পনার ভিত্তিতেই ঠান্ডা মাথায় এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।

আসামীর বর্ণনায় জানা যায় গত ২১ মে দুপুর অনুমান সময় ত্রিশাল ২ টায় ত্রিশাল থানাধীন রামপুর ইউনিয়নের কাকচর নয়াপাড়া গ্রামের জনৈক প্রবাসী কামরুল হাসান এর চাষের জমির আইলের পাশে মাংস বিহীন হাড় মাটির উপর পড়ে থাকা সংক্রান্ত সংবাদের ভিত্তিতে ত্রিশাল অফিসার ইনচার্জ এর নেতৃত্বে ত্রিশাল থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়।

তারা সেখানে গিয়ে পোকায় খাওয়া ৩ টি অর্ধগলিত লাশ দেখতে পান। ২ টি শিশুর লাশ ধান ক্ষেতের উপর এবং ১ টি লাশ আইলের পাশে মাটিতে পুতে রাখা অবস্থায় দেখতে পান। মাটিতে পুতে রাখা লাশ উত্তোলন করে একটি মহিলার অর্ধগলিত লাশ সনাক্ত হলেও মহিলার পরিচয় সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

থানা পুলিশের পাশাপাশি পুলিশে অন্যান্য বিশেষায়িত ইউনিট পিবিআই, সিআইডি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রযুক্তির সহায়তায় লাশের পরিচয় সনাক্তের চেষ্টা করেন কিন্তু লাশগুলো অর্ধগলিত হওয়ায় এবং শিশু বাচ্চা দুইটির লাশ মস্তক বিহীন হওয়ায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিং এর মাধ্যমে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

পরবর্তীতে ঘটনাস্থলেই লাশগুলোর সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য কার্যাদি সম্পন্ন করে ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহের নিমিত্তে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে লাশগুলো প্রেরনের জন্য ত্রিশাল থানায় নিয়ে আসা হয়।

ভিকটিম আমেনা খাতুনের পরিবারসূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবারের পর থেকে মেয়ে ও মেয়ের জামাইয়ের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করতে না পেরে আলী হোসেনর শ্বশুড়বাড়ীর লোকজন খোঁজ নিতে আসে এবং তারা জানতে পারেন যে, আলী হোসেন ঢাকার উদ্দেশ্যে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে গত শুক্রবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।

কিন্তু কোন যোগাযোগ করতে না পারায় এবং তিনটি হত্যাকান্ডের সংবাদ শুনে ভিকটিম আমেনা খাতুনের আত্মীয়-স্বজন থানায় এসে ভিকটিমদের কাপড়-চোপড় এবং অন্যান্য আলামত দেখে পরিচয় নিশ্চিত করেন যে ভিকটিম মহিলা তাদের মেয়ে। লাশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক হল মা এবং সন্তান।

ভিকটিম আমেনা খাতুন এর মা মোছা. হাসিনা খাতুন (৬৫), স্বামী-মোঃ আঃ খালেক, সাং-বাবুপুর, ইউপি-সাখুয়া, থানা-ত্রিশাল, জেলা-ময়মনসিংহ তিনি তার মেয়ের জামাই আলী হোসেনের বিরুদ্ধে ত্রিশাল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।

মামলায় আলী হোসনে (৩৫), পিতা-মোঃ আব্দুল হামিদ, সাং-কাকচর নয়াপাড়া, ইউপি-রামপুর, থানা-ত্রিশাল, জেলা-ময়মনসিংহসহ অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়। মামলা নং-২৩, তারিখ-২২/০৫/২০২৪ খ্রিঃ, ধারা-৩০২/৩০১/৩৪ পেনাল কোড-১৮৬০।

মামলা দায়ের পর ময়মনসিংহ জেলা ডিবি পুলিশের উক্ত ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও আসামী গ্রেফতারের জন্য মাঠে নামেন। ধৃত আসামী দিন মজুর।

সংসারের অভাবের কারণে সে বিভিন্ন সময় তার স্ত্রী ভিকটিম আমেনার নাম দিয়ে এনজিও থেকে টাকা তুলত। বেশ কিছুদিন পূর্বে সে এনজিও থেকে ১,৭০,০০০/-টাকা ঋণ নেয়। সেই টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় তাকে এবং তার স্ত্রীকে প্রায়ই অপমান হতে হত।

অধিকাংশ সময় তার ছেলেরা ও তার স্ত্রী না খেয়ে দিন কাটাত। ঋণের বোঝা, মানুষের অপমান, সংসারের অভাব অনটন থেকে মুক্তি পেতে ২/৩ মাস পূর্বেই আলী হোসেন সিদ্ধান্ত নেয় তার স্ত্রী ও সন্তানদ্বয়কে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করবে।

পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আসামী আলী হোসেন গত ১৭ মে শুক্রবার রাত অনুমান ২টার সময় তার স্ত্রী আমেনা খাতুনকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে।

তার স্ত্রী আমেনা খাতুন বিছানা থেকে নেমে ঘরের মেঝেতে গিয়ে বসলে আলী হোসেন তার পিঠের পিঁছনে গিয়ে তার গায়ে থাকা ওড়না দিয়ে আমেনা খাতুন এর গলায় পেঁছিয়ে মাটিতে ফেলে দুই হাত দিয়ে টান দিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

তারপর বিছানায় আসামী আলী হোসেন এর দুই ছেলে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তার স্ত্রীর গলা থেকে ওড়না খুলে নিয়ে প্রথমে ছোট ছেলে আনাছ এর গলায় ওড়না পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং পরপরই তার বড় ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিকি এর গলায় ওড়নার বাকী অংশ দিয়ে পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।

পরে আসামী আলী হোসেন এর স্ত্রীকে কাঁধে তুলে নিয়ে ঘরের পিছন দিয়ে জঙ্গলে নিয়ে রাখেন এবং এর পরপরই তার দুই ছেলেকেও কোলে করে ঐ জঙ্গলে নিয়ে আসে।

তারপর জনৈক ইউসুফ ও কালামের জমির মাঝখানে সীমানা বরাবর মাটিতে গর্ত করে তার স্ত্রী ও তার ০২ সন্তানকে পুতে রাখে। ভোরের দিকে সেখান থেকে চলে এসে আসামী ঘরে ঘুমিয়ে পরে।

আসামী আলী হোসেন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আনুমানিক সকাল ১০ টায় বাড়ী হইতে হরিরামপুর এলাকায় চলে যায় এবং বিকালে বাড়ীতে ফিরে এসে মালামাল নিয়ে গফরগাঁও মশাখালী ষ্টেশনে গিয়ে ট্রেনে উঠে কমলাপুর রেল ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা করে।

ডিবির হাতে গ্রেফতারের আগে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় গোপনে ছিল।

উল্লেখ্য একই আসামীর বিরুদ্ধে ত্রিশাল থানায় ২০১২ সালে ধর্ষণ এবং শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনায় একটি মামলায় ০৫ বছর কারাভোগ করে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে জামিনে মুক্তি লাভ করেন। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর