করোনাকালে কোরিয়ায় ইতিহাসের কাছে

প্রযুক্তির দুই জায়ান্ট দেশ কোরিয়া ও জাপানের সম্পর্ক ভালই চলছিল, কিন্তু করোনাকালে হঠাৎ নতুন করে কূটনীতিক ঝড়, করোনাকালে কোরিয়া ধরনা দিল ইতিহাসের কাছে। পাঠক কি সে ইতিহাস জানতে হলে যেতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটনা প্রবাহে ও বিশ্লেষণে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জাপান ও কোরিয়ার গণমাধ্যমে চিরস্থায়ী প্রায়শ্চিত্ত নামের একটি যুগল মূর্তি খবর ছাপা হয়েছে। যা কোরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর পিওয়ংচ্যাংয়ে কোরিয়া বোটানিকাল উদ্যানে।যেটি সাম্প্রতিক সময়ে বসানো হয়েছে। এক বালিকাকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। তবে বালিকার সামনের একটু দূরে বসানো আছে আরেকটি মূর্তি। একজন পুরুষ নতজানু বিনয়াবনত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। আপাতদৃষ্টিতে নিষ্পাপ মূর্তি হিসেবে এটাকে দেখা গেলেও পুরুষের দিকে ভালোভাবে চোখ মেলে তাকালে একদম পরিষ্কার হয়ে ওঠে, সেই ব্যক্তি অন্য কেউ নন, বরং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে।

এবার যাই পেছনের দিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বির্তকিত ভূমিকার জন্য জাপানের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া ও বড় অংকের অর্থ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা আসার পরও মূলত ‘যৌনদাসী’ নামের সিরিজ ভাস্কর্যের কারণে সিউল-টোকিও সম্পর্কের চিড় অনেক আগ থেকেই। ইন্টারনেট জগতে ঘুরে যা পেলাম, ১৯৩০ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দক্ষিণ কোরিয়ার পেননুলিসিয়া অঞ্চলে পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইন, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে যুবতীদের ধরে নিয়ে জাপান সম্রাটের সৈন্যরা দাস বানিয়ে রেখেছিল। ইতিহাসবিদের হিসাব মতে প্রায় ২ লাখ নারীকে জাপানি সৈন্যরা দীর্ঘদিন যৌনকর্ম ও ঘরের কাজের দাসী হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এদের বলা হত কমপোর্ট ওমেন।

এদের মধ্যে প্রায় ৪৬জন দক্ষিণ কোরিয়ার নারী এখনো বেঁচে আছেন যাদের অধিকাংশের বয়স নব্বইয়ের বেশি, কয়েজ্জন শতবর্ষী। ১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছরই সেসব যৌনদাসীদের সঙ্গে কোরিয়ার সাধারণ মানুষ জাপান দূতাবাসে স্থাপিত ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করেন। পুরো দক্ষিণ কোরিয়া জুড়ে এমন প্রায় ৩৩টি ভাস্কর্য রয়েছে বলে জানা যায়।

যৌনদাসী ভাস্কর্যকে ঘিরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টোকিওর বিতর্কিত ভূমিকার কথা সব সময় অপমানের চোখে দেখা হয়।

এদের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে জাপান দূতাবাসের সামনে ‘যৌনদাসী’র প্রতিরুপি একটি ভাস্কর্য তৈরি করা হয়।

২০১৭ সালে ২৮ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে জাপান কনসুলার ভবনে আরেকটি স্বর্ণনির্মিত ‘যৌনদাসী’ভাস্কর্য স্থাপন করার মধ্য দিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়।

এর আগে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদের মুখ্য কর্মকর্তা ইয়োই কোনে একটি বিবৃতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সৈন্যদের দ্বারা যেসব নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের অর্থ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেন।

এর জন্য জাপান সরকার গোপনে নাম সংগ্রহ করছেন বলে তিনি জানান। বিবৃতিতে জাপানি সৈন্যদের ব্যক্তিগত দোষের খেসারত দক্ষিণ কোরিয় নারীদের দিতে হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। জাপানের পক্ষ থেকে একটি ক্ষমা প্রার্থনার চিঠি দেওয়ার কথাও বলা হয়।

জানা যায়, ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও কোরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হে কয়েক দফা আলোচনা করেও সফলতা পাননি। ২০১৩ সালে পুনরায় ‘যৌনদাসী’দের বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই সময় জাপানের পক্ষ থেকে সিউলের দূতাবাসের সামনে স্থাপিত ওই ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা ভেস্তে যায়।

তবে ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর শিনজো আবে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে আলোচনায় আসে ‘যৌনদাসী’ বা ‘কমফোর্ট উইমেন’।

২০১৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের পক্ষ থেকে সে সময়কার পরারষ্ট্রমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা যৌনদাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। এরপর তিনি বলেন, ঘোষিত চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ওইসব নারীদের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার গঠিত তহবিলে ১শ’ কোটি ইয়েন (৮৩ লাখ ডলার) ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তবে বিনিময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে জাপান দূতাবাসের সামনে থাকা এক কিশোরীর ভাস্কর্য (যেটি ‘কমফোর্ট উইমেন’এর আদলে তৈরি) অন্যত্র সরিয়ে নেবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি ভুলে থাকার জন্য এমন বড় অর্থ সহায়তা যুদ্ধাপরবর্তী সময়ে বিশ্বে খুব কম দেশই করেছে।

কিন্তু না, দক্ষিণ কোরিয়াবাসী তা ভুলতে চায় না। তারা অর্থের কাছে ইতিহাসকে দমিয়ে রাখার বিপক্ষে। এর পর বুসানে জাপান কনসুলার ভবনে সোনার যৌনদাসীর মূর্তি বানিয়ে নতুন করে বির্তক তৈরি করে। এই করোনাকালে আবার দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘চিরস্থায়ী প্রায়শ্চিত্ত’ নামের একটি যুগল মূর্তি বসিয়ে নতুন করে সামনে নিয়ে আসে।উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর পিওয়েংচাংয়ের কোরীয় বোটানিকাল উদ্যানে এক বালিকাকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায়। তবে বালিকার সামনের একটু দূরে বসানো আছে আরেকটি মূর্তি। একজন পুরুষ যেখানে নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। অনেকে বলছেন নতজানু হওয়া মূর্তিটি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের।

করোনাকালে দুই প্রযুক্তির দেশের কূটনীতির রেশ বা সম্পর্কের রেশই অর্থনীতিতে পড়বে। তবে বর্তমান মুনজে ইনের সরকার জনমতের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক, সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া

বৈশাখী নিউজজেপা