কূটনীতিতেও ছিল বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ প্রজ্ঞা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর থেকে তাকে নিয়ে নানামাত্রিক আলোচনা হয়, লেখালেখি হয়। অজানা অনেক কথা আমরা বিভিন্নজনের আলোচনা বা লেখার মাধ্যমে জানতে পারি। বিখ্যাত মার্কিন ইতিহাসবিদ স্ট্যানলি ওলপার্ট তার ‘Zulfi Bhutto of Pakistan : His Life & Times’ গ্রন্থে পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির অব্যবহিত আগের কিছু ঘটনার বর্ণনা করেছেন (পৃষ্ঠা : ১৭৩-৭৪)। এতে কূটনীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞার সুস্পষ্ট পরিচয় মেলে।

প্রয়াত কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী তার ‘দেশ-দেশান্তর’ বইয়ে বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ওলপার্ট লিখেছেন, দীর্ঘ কারাজীবনে অভ্যস্ত মুজিব জেলখানায় বসেই বুঝতে পারেন যে, যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। কারণ জঙ্গি বিমানের শব্দ তিনি আর পাচ্ছেন না। তাকে সিহালা গেস্ট হাউসে নিয়ে আসার পর বিষয়টি তার কাছে আরও স্পষ্ট হয়। সিহালায় ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে প্রাথমিকভাবে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। অতঃপর মুজিবকে বলেন, ভারতীয় সেনারা ঢাকা দখলে নিয়েছে।

ভুট্টোর বলার ভঙ্গি এমন ছিল যে, পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়েছে তা যেন শেখ মুজিব বুঝতে না পারেন। তবুও মুজিব সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেন- বাঙালি কোনো শক্তির আধিপত্য মেনে নেবে না। প্রয়োজনে এ বিষয়ে তিনি ভুট্টোর সহায়তা নেবেন। আবার আলোচনার একপর্যায়ে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেন, আমরা কি আবার একসঙ্গে থাকতে পারি না? মুজিব তুমি কথা দাও, আমরা একসঙ্গে থাকব। বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দেন- ‘আগে আমি আমার মানুষের কাছে ফিরে যাই। ভুট্টো তুমি আমাকে ঢাকায় যেতে দাও।’ তখন ভুট্টো মুজিবকে বলেন, আরও কয়েকদিন তুমি পাকিস্তানে থেকে যাও, ইরানের প্রেসিডেন্ট বনি সদর পাকিস্তান সফরে আসছেন। বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন, বনি সদরের সঙ্গে আমার পরে দেখা হওয়ার সুযোগ মিলবে। তুমি আমার যাওয়ার ব্যবস্থা কর। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় তাকে পিআইএর বিমানে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দিনটি ৮ মার্চ ১৯৭২। লন্ডনেও আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে। আমরা অন্যত্র এ বিষয়ে আলোচনা করব।

লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধু রয়্যাল এয়ারফোর্সের উড়োজাহাজে প্রথমে দিল্লিতে, পরে ঢাকায় আসেন। এটি তার কূটনৈতিক শিষ্টাচার। ইতোমধ্যে তিনি জেনে গেছেন ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কী অবদান রেখেছে। দিল্লিতে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে পালাম বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রাথমিক সাক্ষাতেই বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞেস করেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য কবে প্রত্যাহার করা হবে। ইন্দিরা গান্ধী উত্তর দেন, যেদিন আপনি চাইবেন। বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন, তখন ভিভি গিরি তার সরকারি উড়োজাহাজ ‘রাজহংসে’ ঢাকায় আসার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, যেহেতু তিনি ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানে এসেছেন, অতএব দিল্লি থেকে এটি ত্যাগ করা সৌজন্যপূর্ণ হবে না। এটিও কূটনীতির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে। তিনি কিছু বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধিতা ও ভারত-বিরোধিতার বিষয়ে অবগত ছিলেন। ঢাকায় এসে রেসকোর্সের ভাষণে তিনি ভুট্টোর প্রস্তাবের জবাব দেন- ‘ভুট্টো তুমি ভালো থাক, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র, বাংলাদেশকে তার মতো করে থাকতে দাও।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, তবে বিশ্বে দ্বিতীয় মুসলিমপ্রধান দেশ। সবার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকবে।’ এখানেও তিনি প্রজ্ঞার পরিচয় দেন।

শোনা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ভারতের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেটি বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট সম্মানজনক ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে এ বিষয়ে বলা হলে তিনি উত্তর দেন- যুদ্ধকালীন সময়ে এরকম বহু চুক্তি হতে পারে, এখন এগুলো মূল্যহীন। একথাটি শুধু বঙ্গবন্ধুই বলতে পারেন, অন্য কেউ নয়। এজন্যই ১০ জানুয়ারি বাঙালির সত্যিকারের মুক্তির দিন।

লেখক: উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

বৈশাখী নিউজজেপা