যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো অস্ত্রে যুদ্ধের মোড় ঘুরবে?

টুইটারে পোস্ট করা ছবিতে ধুলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে পুড়ে যাওয়া রুশ ট্যাংকের ধ্বংসাবশেষ, পরের এক ছবিতে ইউক্রেনের এক সেনার হাতে সেই অস্ত্র, যা ওই ট্যাংকটি গুড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
এ ছবিগুলোর সঙ্গে ক্যাপশনও জুড়ে দিয়েছে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী; সেখানে তারা বলছে, এটা (রাশিয়ান) সামরিক সরঞ্জামের ওপর জেভেলিনের আঘাতের ফল। ট্যাংকবিধ্বংসী এই জেভেলিন কাঁধে রেখে ব্যবহার করা যায়; এগুলো থেকে ছোড়া তাপ-সন্ধানী রকেটগুলো ৪ কিলোমিটার দূরের টার্গেটে আঘাত হানতে পারে।
অস্ত্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় একটি সহজে বহনযোগ্য ইউনিট দিয়ে, যার সঙ্গে ভিডিও গেইম কনসোলের কোনো পার্থক্য না থাকলেও এটিই এক মিটার দীর্ঘ একটি ক্ষেপণাস্ত্রকে সরাসরি একটি ট্যাংকের পাশে বা উপরে পাঠিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বানানো এই অস্ত্র এরই মধ্যে রুশ বাহিনীতে ‘আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে’ বলে দাবি ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর। আরও প্রায় ২ হাজারটি জেভেলিন পেতে যাচ্ছে তারা।
বুধবার (১৬ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনের জন্য যে নতুন ৮০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা ঘোষণা করেছেন তার মধ্যে যেসব অস্ত্রের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, সেখানে ট্যাংকবিধ্বংসী জেভেলিনও আছে। অন্য অস্ত্রগুলোর মধ্যে ড্রোনও আছে, যেগুলো উড়ন্ত বোমায় পরিণত হতে পারে, ব্যবহার করা যেতে পারে বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র হিসেবেও, যা হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে পারবে।
কিন্তু সংখ্যা ও বৈচিত্র্যে বেশ শক্তিশালী রুশ বাহিনীকে হটাতে এসব অস্ত্রের চালান কি ইউক্রেনীয়দের সহায়তা করতে পারবে?
যেসব অস্ত্র দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সহায়তার নতুন চালানে নানান ধরনের সামরিক উপকরণ আছে। এগুলোর মধ্যে আছে ২৫ হাজার সেট উপকরণ, যার প্রতিটি সেটে দেহবর্ম ও হেলমেট থেকে শুরু করে রাইফেল ও গ্রেনেড লঞ্চারও আছে। আছে কয়েক হাজার নানান ধরনের ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র এবং ২ কোটি রাউন্ডের বেশি গুলি। মার্কিন সহায়তায় জেভেলিন ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি ৮০০টি স্টিঙ্গার বিমানবিধ্বংসী ব্যবস্থাপনাসহ আরও কিছু শক্তিশালী অস্ত্রও আছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিমান ভুপাতিত করে স্টিঙ্গার ব্যাপক পরিচিতি পায়।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে ১০০টি ছোট ড্রোন পাঠানোর কথাও ভাবছে, যেগুলো হাতের সাহায্যেই ছোড়া যায় এবং এতই ছোট যে কারও কাঁধের ব্যাগেই তা এটে যাবে। এবারের চালানে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে একবার ব্যবহারে সক্ষম ৬ হাজার এটি-৪ ট্যাংকবিধ্বংসী ব্যবস্থাপনাও পাঠাচ্ছে।
বুধবারের (১৬ মার্চ) ঘোষণাসহ বাইডেন মাত্র কয়েকদিনেই ইউক্রেইনকে ১০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেন; অথচ ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ এর শুরু পর্যন্ত দেশটিতে মার্কিন সহায়তার পরিমাণ ছিল সব মিলিয়ে ২৭০ কোটি ডলার।
এগুলো রাশিয়ার স্থল ও বিমানহামলায় কী প্রভাব ফেলবে?
ইউক্রেনে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্রেই সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যাচ্ছে বলে মত সমর বিশেষজ্ঞদের। এখন পর্যন্ত দেখা রুশ বাহিনীর মূল শক্তিই সাঁজোয়া যান নির্ভর, তাহলে সবচেয়ে সেরা যে কাজটি আপনি করতে পারেন, তা হলো তাদের যানগুলোকে ধরাশায়ী করা, বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল ক্রিস্টোফার মেয়ার।
ইউক্রেন একাধিক দেশের কাছ থেকে নানান ধরনের ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র পেয়েছে, যা রাশিয়ার যানগুলোর বিরুদ্ধে ইউক্রেইনীয় বাহিনীর শক্তিমত্তা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে, বলেছেন মেয়ার। ইউক্রেনের কর্মকর্তারাও বলছেন, এ ধরনের অস্ত্র তাদের বেশ কাজেও লাগছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, ১৬ মার্চ (বুধবার) পর্যন্ত তারা রাশিয়ার ৪০০র বেশি ট্যাংক এবং ২ হাজারের বেশি অন্যান্য যান ধ্বংস করেছে।
কিন্তু এই ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র রুশ বিমান বাহিনীর বিরুদ্ধে মোটেও কার্যকর নয়, যে বাহিনী এরই মধ্যে ইউক্রেনজুড়ে বিভিন্ন লক্ষ্যে একের পর এক আঘাত হেনে যাচ্ছে। এগুলোর বিরুদ্ধে কেবল সহজে বহনযোগ্য, কাঁধে রেখে ব্যবহার করা যায় স্টিঙ্গার বিমানবিধ্বংসী অস্ত্রই যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রতিশ্রুত সাহায্যে থাকছে।
১৯৮১ সাল থেকে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে এই স্টিঙ্গারের ব্যবহার দেখা গেছে। এগুলো সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৮০০ মিটার উপর দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম হেলিকপ্টার ও বিমানের বিরুদ্ধে কার্যকর হলেও খুব উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়া রুশ বোমারু বিমানের কিছুই করতে পারবে না। ‘তাদের অবশ্যই আরও স্টিঙ্গার দরকার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের খুব উঁচুতে উড়ে যাওয়া বিমানে আঘাত হানতে সক্ষম এমন অস্ত্রও দরকার,’ বলেছেন কিইভে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত জন হার্বস্ট।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য সোভিয়েত আমলের এস-৩০০ বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রসহ উঁচুতে উড়ে যাওয়া বিমান মোকাবিলায় অস্ত্র তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে ইউক্রেইনে পাঠানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। স্লোভাকিয়ার কর্মকর্তারা ইউক্রেনে এস-৩০০ পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন; নেটোর আরও দুই সদস্য গ্রিস ও বুলগেরিয়ার কাছেও এই অস্ত্র রয়েছে।
পোল্যান্ড চেয়েছিল তাদের মিগ-২৯ জঙ্গিবিমানগুলো জার্মানির মার্কিন ঘাঁটির মাধ্যমে ইউক্রেনে পাঠাতে; তেমনটা হলে ইউক্রইনের বিমানচালকরা আকাশযুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারতেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ওই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে। তাদের ভাষ্য, এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলে তা ন্যাটো ও রাশিয়াকে মুখোমুখি যুদ্ধে নামিয়ে দিতে পারে।
ক্রিস্টোফার মেয়ারের মতে, মিগ-২৯ বা মার্কিন মিত্রদের হাতে থাকা কাছাকাছি ধরনের বিমান ইউক্রেইনকে দিলে তারা দেশের আকাশ নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারত। সোভিয়েত ইউনিয়ন এক সময় বিস্তৃত যুদ্ধে না জড়িয়েও উত্তর ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানের মোকাবিলায় তাদের বিমান ও বিমানচালক পাঠিয়েছিল—সে ঘটনার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
অন্য দেশগুলো কী করছে?
না, কেবল যুক্তরাষ্ট্রই ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে না; এর বাইরেও অন্তত ৩০টি দেশ কিয়েভ সরকারকে অস্ত্র পাঠাচ্ছে; ইউরোপীয় ইউনিয়নও ৫০ কোটি ইউরো সাহায্য পাঠাচ্ছে, ইতিহাসে এর আগে এমনটা কখনোই দেখা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য তাদের নতুন সহযোগিতা প্যাকেজ ঘোষণা করার পর প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জরুরিভিত্তিতে ‘আরও সহযোগিতা’ পাঠানোর অনুরোধ করেন। এখন যা পেয়েছি তার চেয়ে বেশি দরকার; রাশিয়ার দখলদার বাহিনীকে থামাতে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা, বিমান, পর্যাপ্ত প্রাণঘাতী অস্ত্র ও গোলাবারুদ দরকার, বলেছেন তিনি।
মেয়ারের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত ইউক্রেইনে যেসব অস্ত্র পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেগুলো কেবল ইউক্রেইনীয়দের ‘নায়কোচিত মৃত্যুরই’ সুযোগ করে দেবে। আমাদের যা আছে, তা তাদেরকে দিতে আমাদের আরও আগ্রাসী হওয়া দরকার। আমাদের অন্তত তাদেরকে সেই মানের, সেই সংখ্যক কর্মী দেয়া দরকার, যেমনটা উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধের সময় তারা (সোভিয়েত ইউনিয়ন) ভিয়েতনামিদের দিয়েছে, বলেছেন তিনি।
হার্বস্ট বলছেন, সামনের দিনগুলোতে ইউক্রেনে আরও সহায়তা পাঠানো দরকার হয়ে পড়বে। আর সেসব সাহায্য তখনই কার্যকর হয়ে উঠবে যখন সেগুলোর মাধ্যমে ইউক্রেইন রুশ বিমানবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে। এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিলেও দরকার পড়লে ইউক্রেন যেন দূরপাল্লার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র সেজন্য কাজ করছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বাইডেনও। ‘আরও সহায়তা আসছে,’ ইউক্রেনীয়দের আশ্বস্ত করে বলেছেন তিনি।