পুকুর চুরি করেও বহাল তবিয়াতে পরিচালক ডা. মো. আমির হোসাইন!

আপডেট: January 25, 2023 |

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে একটি বালিশের দাম ৬ হাজার টাকা, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি পর্দা কিনতে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় দেখানোর ঘটনাগুলো দেশ জুড়ে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন কার্যালয়ে ওষুধ, সরঞ্জাম এবং যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সিন্ডিকেট গঠন করে স্বাস্থ্য খাতে জনসাধারণের জন্য বরাদ্দ সরকারি বাজেটের ৮০ শতাংশ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এসব দুর্নীতিবাজরা।দেশে এসব ‘পুকুর চুরি’ যেন কিছুতেই থামছে না । তেমনি একজন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক ডা. মো. আমির হোসাইন পুকুর চুরি করেও ক্ষমতার দাপটে বহাল তবিয়াতে রয়েছেন তার পদে। দুদকের তদন্তে শাস্তি পাওয়া ডা. মো. আমির হোসাইনের ব্যাপক অনিয়ম উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যন্ত্রপাতি কেনাকাটার বিরাট কেলেঙ্কারি। গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পরিচালক থাকাকালীন সময়ে ডা. মো. আমির হোসাইন রক্তের রোগ থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ের যন্ত্র কেনেন বরাদ্দের প্রায় আট গুণ বেশি ব্যয়ে।

 

জানা গেছে, অ্যানেসথেসিয়া ভেন্টিলেটর নামের একটি চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা, কিন্তু কেনা হয়েছে প্রায় ১২ গুণ বেশি খরচে। এমনকি যেসব যন্ত্রপাতি কেনারই কথা ছিল না, সেসবও কেনা হয়েছে।
এ প্রকল্পে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৯২৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ৭ তলা হাসপাতাল ভবনকে ১৫ তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা। আরও ছিল কলেজের একাডেমিক ভবন ও শিক্ষার্থীদের জন্য ডরমিটরি নির্মাণ। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৯২৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় এ প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকায় উন্নীত করতে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হলে তখন কেনাকাটার বিরাট অনিয়ম ধরা পড়ে।
এক প্রকল্পে এত অনিয়ম দেখে পরিকল্পনা কমিশনও বিস্মিত। এভাবে ব্যয় করাকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলছে কমিশন। বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, এটা তো পুকুরচুরি নয়, সাগরচুরিকেও হার মানিয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, রক্তের রোগ থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়ে পরীক্ষার জন্য একটি ইলেকট্রোফোরিসেস হিমোগ্লোবিন যন্ত্র কিনতে খরচ ধরা হয়েছিল ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। কিন্তু নেদারল্যান্ডস থেকে তা কেনা হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকায়। অর্থাৎ প্রায় আট গুণ বেশি ব্যয়ে যন্ত্রটি কেনা হয়েছে। বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সেখানে এ ধরনের একটি যন্ত্র আছে। ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা রকিব হাসান জানালেন, এই যন্ত্রের দাম ২০ লাখ টাকার মধ্যে।
আবার একটি অ্যানেসথেসিয়া ভেন্টিলেটরের দাম ধরা ছিল ৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা। কিন্তু যুক্তরাজ্য থেকে ভেন্টিলেটর কেনা হয়েছে ১২ গুণ বেশি দামে, ৫৭ লাখ ২৯ হাজার টাকায়। চোখে ছানি পড়ার পর লেন্স লাগানোর কাজে ব্যবহৃত হয় ফ্যাকো ইমালসিফায়ার। এটি আমদানিতে খরচ ধরা হয়েছিল ২০ লাখ টাকা, কিন্তু কেনা হয়েছে ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকায়। প্রকল্পে ১২টি আইসিইউ ভেন্টিলেটর আমদানি করার কথা, দাম ধরা ছিল প্রতিটি ৫ লাখ টাকা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা প্রতিটি আইসিইউ ভেন্টিলেটরের পেছনে খরচ পড়েছে ৪৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ আট গুণ বেশি দামে ভেন্টিলেটর কেনা হয়েছে।
আবার এই প্রকল্পে কেনাকাটার কথা ছিল না, সেসবও কেনা হয়েছে বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে। যেমন অর্থ বরাদ্দ না থাকলেও টেবিল ফর গাইনোকোলজি কেনা হয়েছে ৩১ লাখ ৮৯ হাজার টাকায়। একইভাবে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে কালার ডপলার আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন উইথ ফোরডি, ৫ লাখ ৫২ হাজার টাকায় পালস অক্সিমিটার ডেস্কটপ এবং ৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকায় ইসিআর ল্যাব অটোমেশন।

এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘একনেকের অনুমোদন ছাড়া বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে আসবাব ও যন্ত্রপাতি কেনার ঘটনা সরাসরি সরকারের আর্থিক ক্ষতি। আমরা প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনি বেশি দামে যেসব যন্ত্রপাতি কিনেছেন, টাকা পেয়েছেন কোথায়? তখন পিডি বলেছেন, অন্য খাত থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এমনটা করার কোনো সুযোগ নেই।’
আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, অনিয়মের বিষয়ে কেউ দায় এড়াতে পারেন না। অনিয়মের আওতায় এসব বিল হিসাব বিভাগ কীভাবে অনুমোদন করেছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারা এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তা খুঁজে বের করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন যেসব যন্ত্রপাতি অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটার কথা বলছে, সেটি আসলে কতটা যৌক্তিক, তা পর্যবেক্ষণে সমজাতীয় একটি প্রকল্প বিশ্লেষণ করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের ঋণে করোনা প্রতিরোধে নেওয়া ‘কোভিড–১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পটির আওতায় বেশ কিছু স্বাস্থ্য সরঞ্জাম আমদানি করা হয়েছে এ বছর। এ প্রকল্পের আওতায় মোট ৩০০টি আইসিইউ ভেন্টিলেটর আমদানিতে প্রতিটির পেছনে বরাদ্দ ছিল ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৩৭০টি কার্ডিয়াক মনিটর আমদানিতে বরাদ্দ ছিল প্রতিটিতে ৫ লাখ টাকা। প্রতিটি ইসিজি মেশিন (১২ চ্যানেল) আমদানিতে বরাদ্দ ছিল দুই লাখ টাকা। প্রতিটি উচ্চতা ও ওজন মাপার যন্ত্র কিনতে খরচ ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার টাকা।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর