ভালো বন্ধু কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়ায়, জাপান সেই বন্ধু : ড. ইউনূস


বর্তমান সভ্যতার ধারায় পৃথিবী টিকে থাকতে পারবে না উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তরুণদের ‘থ্রি জিরো ক্লাব’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকাল শুক্রবার টোকিওর সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাকালে তিনি এ আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বেকারত্বের সমস্যা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যালেঞ্জগুলোর দিকেও আলোকপাত করেন তিনি।
তরুণ প্রজন্মকে নতুন এক বিশ্ব গড়তে সৃজনশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেন, চাকরি মানুষের সৃজনশীলতাকে দমন করে।
‘থ্রি জিরো ক্লাব’ সম্পর্কে তিনি বলেন, পাঁচজন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে একটি থ্রি জিরো ক্লাব গঠন করতে পারে, যেখানে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে যে, তারা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করবে না।
অনুষ্ঠানে সোকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাপী সামাজিক উদ্ভাবন এবং বৈশ্বিক উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে এই ডিগ্রি দেওয়া হয়।
এদিকে বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে জাপানের সর্বাত্মক সহযোগিতা চেয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল টোকিওতে জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) ও জাইকা আয়োজিত ‘বাংলাদেশ বিজনেস সেমিনার’-এ তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার চিত্র তুলে ধরে জাপানের সহায়তার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ গত ১৬ বছর ধরে এক ধরনের ভূমিকম্পের মধ্য দিয়ে গেছে, যেখানে সবকিছু ভেঙে পড়েছে। এখন আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সেই ভাঙা অংশগুলো নতুনভাবে গড়ে তোলা।’
তিনি জাপানকে বাংলাদেশের ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘একজন ভালো বন্ধু কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়ায় এবং জাপান সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে।’
ড. ইউনূস তার বক্তব্যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংকট তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা বড় বিপদের মধ্যে আছি। আক্ষরিক অর্থে বাংলাদেশ গত ১৬ বছর ধরে এক ধরনের ভূমিকম্প পার করেছে। সবকিছু ভেঙে পড়েছে এবং এখন আমাদের মূল লক্ষ্য হলো সেই টুকরো অংশগুলো নতুনভাবে গুছিয়ে তোলা।’
তিনি জাপানকে বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘একজন ভালো বন্ধু কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়ায় এবং জাপান সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে। আমাদের কাজ হলো অসম্ভবকে সম্ভব করা, আর এই চ্যালেঞ্জে জাপান আমাদের সঙ্গী হয়ে পাশে থাকলে তা বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব।’
দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক: টোকিওতে গতকাল জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
১. জ্বালানি খাতে সহযোগিতা: জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি) এবং বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি।
২. গ্যাস মিটার প্রকল্প: অনোডা এবং বাংলাদেশ এসইজেড লিমিটেডের মধ্যে সমঝোতা স্মারক।
৩. ব্যাটারিচালিত সাইকেল ও মোটরসাইকেল: গ্লেফিট ও মুসাসি সিমিতসু ইন্ডাস্ট্রির বাংলাদেশে বিনিয়োগ-সংক্রান্ত স্মারক।
৪. তথ্য নিরাপত্তা ও ডিজিটাল অর্থনীতি: সিফার কোর কো. লিমিটেডের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি, যার লক্ষ্য বাংলাদেশকে কোয়ান্টাম-প্রচলিত ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে নিয়ে যাওয়া।
৫. জাপান-বাংলাদেশ বিনিয়োগ: জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মধ্যে চুক্তি।
অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত: জাপানের সঙ্গে নতুন বাজেট সহায়তা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ মোট ১ দশমিক ০৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাবে। এর মধ্যে ৪১৮ মিলিয়ন ডলার ‘ডেভেলপমেন্ট পলিসি ঋণ’ হিসেবে বরাদ্দ করা হবে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার ও জলবায়ু সহনশীলতার উন্নয়নে ব্যয় হবে।
এ ছাড়া, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রুটে ডুয়েল-গেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণের জন্য ৬৪১ মিলিয়ন ডলার ঋণ এবং শিক্ষাখাতে স্কলারশিপের জন্য ৪ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেবে জাপান।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা ইতিহাসকে দেখাতে চাই যে নতুন বাংলাদেশ তৈরি সম্ভব, এবং আমরা তা নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করতে চাই। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো অসম্ভবকে সম্ভব করা, যেখানে জাপান আমাদের সঙ্গী ও বন্ধু।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাপানের সহায়তায় আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করেছি। এখন একসঙ্গে কাজ করে এটি বাস্তবায়নের সময়।’
টোকিওতে বৈঠক ও চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, প্রধান উপদেষ্টার এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং টোকিওতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. দাউদ আলী উপস্থিত ছিলেন।