এই বুঝি আমার উপর অ’স্ত্র হাতে ছাত্রলীগ ঝাঁপিয়ে পড়বে


আগস্টের এক ভারী রাত। বাতাসে ছিল অজানা এক গন্ধ—শঙ্কার, প্রতিবাদের, আর অপার এক অস্থিরতার। কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাল স্রোত বয়ে চলেছে রামপুরা থেকে শাহবাগ, ঢাকার অলিগলি ভরে উঠেছে পোস্টার আর পায়ের শব্দে। সেই রাতে, রামপুরার অলিতে-গলিতে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের দাপট ছড়িয়ে ছিল সর্বত্র। চোখ চিনে ফেললেই হয়তো লাশ পড়ে যাবে কোথাও।
আমার বাসা গুদারাঘাটে। দিনের বেলায় কিছুটা সাহস করে আন্দোলনের ডাকে অংশ নিয়েছিলাম, কিন্তু রাতে সাহস হারিয়ে ফেলি। মুখে মাস্ক পরে, বহু ঘুরপথে এক রিকশায় উঠে আফতাব নগর হয়ে ফিরি। বুকের ভেতর কাঁপন, পেছনে তাকাতে ভয়, সামনে তাকাতে সন্দেহ। কেউ যেন পিছু নেয়নি, নিশ্চিত হয়েও নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।
এই বুঝি আমার উপর অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগ ঝাঁপিয়ে পড়বে।
ঘরে ফিরে ঘুম আর আসে না। চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে আগুন, গুলি, চিৎকার আর রক্তমাখা মুখ। সকাল হতেই ঠিক ৭.৪০ থেকে ৭.৪৫ মিনিট ঘড়ির কাটায় যতদূর মনে পড়ে – ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম:
“বেঁচে ফিরলে দেখা হবে, না ফিরলে ক্ষমা করে দিয়েন”
মনে হলো, এটাই হয়তো শেষ কথা হতে পারে। যদি কিছু ঘটে যায়, কেউ যেন অন্তত চিনতে পারে কে ছিলাম আমি। নিজের নাম, ঠিকানা, খালাতো ভাই নিলয়ের নম্বর লিখে student id কার্ডের পেছনে গুঁজে রাখি,যাতে করে যদি দুর্ঘটনা হয় তাইলে আমার লাশ টা অন্তত গ্রামে পৌছে দিতে পারে।
বিজয় আর সন্দেহের ভেতর
রাস্তায় তখন গুজব ছড়িয়ে পড়ছে বিদ্যুতের গতিতে –
“প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন”
“আমাদের বিজয়!”
“শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন!”
এই ধরনের উচ্চারিত বাক্যগুলো বিকট আওয়াজের সহিত শোনা যাচ্ছিল।
আমারদের কাছে সাধারণ মানুষ ছুটে আসলো-
কেউ কেউ মালা পরিয়ে দিচ্ছে, কেউ মিষ্টি ছড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়।
আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দৌড়ে একটা দোকানে ঢুকে টিভি খুলে দেখি, ব্রেকিং নিউজ। আবারও সন্দেহ, যমুনা টিভি দেখতে চাইলাম। আনন্দে ভেসে যাওয়া মানুষের মাঝে আমি খুঁজে ফিরছিলাম বাস্তবতা।
হঠাৎ ব্রেকিং নিউজ শুনলাম-
পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা
আমাদের দুইজন ছাত্রকে এক রিকশাওয়ালা শাহবাগমুখী আনন্দ মিছিলে তুলে নিল তার গাড়িতে। সবাই গাইছিল বিজয়ের গান, হাততালি দিচ্ছিল আকাশ কাঁপিয়ে। অথচ আমার পেটে খিদের জ্বালা উপচে পড়তে ছিল। বিপ্লব তো চলে না কলা আর রুটিতে। বাসায় ফিরতেই মন চাইল। শুধু একটু সাদা ভাত খেতে পারতাম পেট পুরে
ভাতের গন্ধ ও এক অশুভ বার্তা
বাসায় পৌঁছাতেই খালা দরজা খুলে বললেন,
“মামা, মুবাইল ডা লগে লন নাই, নাই, কত চিন্তায় ছিলাম!
আপনেরা জিতে গেছেন!
আমি শুধু বললাম,
“খালা, ভাত দেন তো”
খালার হাতের গাঢ় ঝোলের মুরগির মাংস, আলুভর্তা আর ভাতের গন্ধে মনে পড়লো ‘মা’ উপন্যাসের ‘আজাদ’-এর কথা। সেদিন শহীদ আজাদ এর মা ও সাদা ভাত, বেগুন ভাজি আর মুরগীর মাংস আজাদের জন্য দুপুরে আহার করাতে নিয়ে গেছিল, কিন্ত আজাদ সেই খাবার মুখে নেওয়ার আগেই বিদায় নিয়েছিল দুনিয়া থেকে।
আমিও তো গত ৪৮ ঘণ্টা শুধু রুটি আর কলা খেয়েছি। কিন্তু সেই ভাত মুখে তোলার আগেই বেজে উঠলো ফোন।
মিল্কী কাঁপা গলায় বলল,
“ভাইয়া, আমাদের বাংলা বিভাগের রাসেলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”
আমার আর ভাত মুখে উঠলো নাহ।
রুমমেট সাহেল ভাইয়ের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে বের হলাম কারণ মানিব্যাগ হারিয়ে ফেলেছিলাম আগেই মিছিলে।
কোন ক্রমে মগবাজার রেলগেটে গিয়ে মিল্কীকে কল দিলাম।
ও পাগলের মতো দৌড়ে এসে
ভাইয়া, চলেন যাত্রাবাড়ী
অনুরোধ করলাম তুমি একটা মেয়ে এই রাতে বের হওয়া ঠিক হবে নাহ, ও কোন কথা ই শুনতে নারাজ সে যাবেই।
ভার্সিটির বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করলাম কেউ সাড়া দেয়নি সেই সন্ধ্যায়।
একটা অপরিচিত মেয়ে ইনবক্সে মেসেজ দিল।
” ভাইয়া ছবিটি দেখুন তো, এই লাশ টা যাত্রাবাড়ী শনির আখড়া জামে মসজিদ এর এখানে রাখা ”
হুবুহু আমাদের রাসেল।
তবে সেদিন সন্ধ্যায়- কোন রিকশা ও সি এন জি যেতে ইচ্ছুক নয় কারণ।
যাত্রাবাড়ী তে এখনো গোলাগুলি চলছে।
এক সিএনজি ড্রাইভার মামা ৬০০ টাকার বিনিময়ে রাজি হইলো।
ছবিতে যে ছেলেটা পড়ে আছে, তার গায়ে রক্ত, মুখে আঘাত, গড়ন অনেকটা রাসেলের মতোই। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। যাত্রাবাড়ী শনির আখড়া জামে মসজিদের কাছে লাশ রাখা। গিয়ে দেখি, শেষ গোছোল সম্পন্ন , জানাজার প্রস্তুতি চলছে। পরিচিত কেউ নেই, রাসেলের পরিবারের কেউ ঢাকায় ছিল না। ভুল লাশ চিনে ফেলার শঙ্কায় বুক ধড়ফড় করছিল। কিন্তু চেহারা মিলছিল না—রাসেল নয়।
মিল্কী আর আমি দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে আশান্বিত হলাম খানিক টা-
তার মানে আমাদের রাসেল মনে হয় বেচে আছে।হয়তো আঘাত পেয়ে ফোন এটা সেটা হারিয়ে কোন এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পড়ে আছে।
হয়তো কোথাও আছে এই আশার তৃষ্ণায় ছুটলাম এক ক্লিনিক থেকে আরেক ক্লিনিকে। যাত্রাবাড়ীর যত ডায়াগনস্টিক, হাসপাতাল—সব ঘুরলাম। কোথাও নেই।
হঠাৎ বন্ধু জয় এসে আমাদের সাথে যুক্ত হইল,
“চল, মিটফোর্ডে যাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ম্যাম- প্রফেসর শামীম আরা হাসান।
সারাক্ষন আমাদের সাথে অনলাইনে যুক্ত বার বার আমাদের খোজ নিচ্ছিলেন।
আমাদের আরেক অভিভাবক বিভাগীয় প্রধান- প্রফেসর শামীম সরকার।
অজান্তেই নগদের মাধ্যমে ২০০০ টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বললেন সাবধানে চলাচল করো আর পারলে কিছু খেয়ে নিও তোমরা আর আমায় আপডেট দিবা একটু পর পর।
সেদিন খুব করে মনে পড়ে যাত্রাবাড়ী মেইন রোড পেরিয়ে যেতে এই পাশ আর অই পাশ থেকে গুলির শব্দ।
পিলারের নিচে পুরোনো টিন চেপে খানিকটা সময় লুকিয়ে থাকলাম আর নিজের আশা ছেড়ে দিয়েছি।
কোন রকমে মিটফোর্ড হাসপাতালে পৌঁছে রিকশার ভাড়া টাও দিতে খেয়াল নেই দৌড়ে আমরা হাসপাতাল এর বেডে শুধু রক্ত আর রক্ত সিড়ি থেকে বেড অব্দি।
হঠাৎ মর্গে প্রবেশ করতে মৃত দেহ গুলোর চেহারা উলটে পালটে দেখা শুরু কারণ রাসেল এর সাথে মিলে কিনা।
লাশের উপরে লাশ ঠিক যেভাবে বালুর বস্তা দিয়ে নদীর পাড় বাধে।
বিরল ঘটনার সম্মুখীন একজন মানুষের শরীর এ হাত পড়তেই জয় বলে উঠলো এই, এই অন্তু -মিল্কী দেখো,
উনি বেচে আছেন এখনো হার্টবিট সচল।
মৃত বলে মর্গে ফেলে দিয়েছে। রক্ত মাখা শরীর কোন ক্রমে টেনে নিলাম তিনজনে মিলে ইমার্জেন্সি তে। কে কারে দেখে অসংখ্য দেহ জরাজীর্ণ অবস্থায় সেখানে পড়ে আছে।খুব করে অনুরোধ করায় একটা নার্স পর্যবেক্ষণ করতে রাজি হইলো।
“হে আল্লাহ আমি জানি নাহ মানুষ টা বেচে আছে কিনা”
এরপর আমাদের রাসেল এর সাথে মেলে নাহ কারও চেহারা, বাইরে এসে দেখি আমরা রিকশাওয়ালা মামা এখনো দাড়িয়ে আছে, ভাড়া না পাওয়ার জন্য বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই তার চোখে মুখে শুধু বলে উঠলো
” মামা আপনাগো লাশ পাইছেন ”
বললাম মামা ঢাকা মেডিকেল যাবেন, মামা কইলো উঠেন আপনারা।
জীবনের সব থেকে বীভৎস স্মৃতি আমাদের তিনজনের।
কারণ অনেক অনুরোধ করায় স্বল্প বয়সের একটা ছেলে মর্গের দরজা খুলে দিল তীব্র গন্ধ আর দ্বীখন্ডিতি দেহ চোখে পড়া মাত্রই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
পরবর্তী ঘটনা খানিকটা আমার অজানা, জ্ঞান ফিরতেই দেখি মিল্কী ও জয় নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
প্রশ্ন???
পাওয়া গেল ??
উত্তর – নাহ
একটা জায়গা বাকি আছে ফ্রীজিং করা লাশের বক্স আর যেখানে পোস্টমাটেম করে সেখানে দেখা।
এই দুইটা জায়গায় সকাল ছাড়া যাওয়া সম্ভব নাহ আর সেখানে ডোম ছাড়া কেউ প্রবেশ করে নাহ সচারাচর।
ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে জয়ের বাসায় একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ফিরে যায়, বন্ধু জয়ের বাবা যুগান্তর পত্রিকায় চাকুরী করেন সকালে প্রকাশিত হওয়ার নিউজের একটা কপি আমাদের সাদা কাগজে প্রিন্ট এনে দেখালেন।
“রাসেল মাহমুদ ”
আনন্দ মিছিলের যাত্রারত অবস্থায় মাথায় গুলি লেগে শহীদ হয়েছেন।
কিন্তু লাশ???
লাশ টা অন্তত ওর পরিবার এর কাছে পৌঁছে দেয়া আমাদের দায়িত্ব।
সকাল ৭ টায় দৌড়ে আবার ঢাকা মেডিক্যাল আসি।
কিছু সময় অপেক্ষা……
ফ্রীজিং করা লাশগুলো খুলে দেখে নিই আমরা কিন্ত চেহারা মিলে নাহ।
ভয়াবহ দানব দেহের অধিকারী দেখলেই গা শিউরে উঠে এমন একজন মানুষের উপস্থিতি – (ডোম)
তিনি পোস্টমাটেম করা ঘরের দরজা খুলতেই
প্রথম সারিতেই আমাদের রাসেল এর নিথর দেহ পড়ে আছে।
বাকি টুকু লিখার সাহসিকতা আমার হয়ে উঠছে নাহ -কাপছে……
একেকটা স্বপ্নের সমাপ্তি।
নিথর, নিস্তব্ধ। মাথায় গুলির চিহ্ন। যেন নিদ্রিত এক স্বপ্নবান যোদ্ধা।
রাসেল, তুই কি ফিরে আসবি?
সে আর আসবে না। ইতিহাসে হয়তো তার নাম লেখা থাকবে না বড় করে। কিন্তু আমি জানি, এই আগস্টে, এক রাতের শরীরে,
সে রেখে গেলো রক্তমাখা একটি সত্য। একটি লাশ। একটি স্বপ্ন।
সাইদ মাহমুদ অন্ত
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ,
সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়।