গত কয়েকদিনের ব্যবধানে সিলেটে ফের বন্যা

পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সিলেটে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ।

গত কয়েকদিনের মতো বুধবার (১৫ জুন) ভোর থেকে সিলেটে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। এতে বন্যার পানি বেড়েই চলেছে।

এরই মধ্যে সিলেট মহানগর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও জকিগঞ্জ উপজেলার সহস্রাধিক গ্রাম, বেশ কয়েকটি বাজার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। গোয়াইনঘাট উপজেলায় বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৪২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

এর আগে গত মে মাসের মাঝামাঝি উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সিলেট মহানগরসহ জেলাজুড়ে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বন্যার পানি সুরমা নদী উপচে নগরের বাসাবাড়িতে প্রবেশ করে। প্রায় ১৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি ছিল। সেই সময়ে সিলেট নগরেও লাখো মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছিলেন। ওই দুর্ভোগের রেশ কাটতে না কাটতে নতুন করে বন্যার কবলে পড়েছে মানুষ।

এদিকে, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর দুটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর তীরবর্তী নগরের বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে এরই মধ্যে পানি প্রবেশ করেছে। নগরের সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার কালীঘাট ও মহাপট্টিতে নদী তীরবর্তী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আবারও পানি ঢুকেছে। একমাস আগের বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আগে আরেক দফা বন্যায় হতাশ ব্যবসায়ীরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয় থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো পানির স্তরসংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, বুধবার বিকেল ৩টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১ দশমিক ১৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কানাইঘাটে বুধবার সর্বোচ্চ ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর আজ সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত মাত্র নয় ঘণ্টার ব্যবধানে সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বেড়েছে দশমিক ৫৯ সেন্টিমিটার।

একই সময়ে সুরমা নদীর পানি সিলেট সদর পয়েন্টে বিপৎসীমার দশমিক ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটে আজ সর্বোচ্চ ৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আর বুধবার সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত মাত্র নয় ঘণ্টার ব্যবধানে সুরমা নদীর সিলেট সদর পয়েন্টে পানি বেড়েছে দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার।

কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে দশমিক ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত মাত্র নয় ঘণ্টার ব্যবধানে কুশিয়ারার এই পয়েন্টে পানি বেড়েছে দশমিক ১২ সেন্টিমিটার।

এছাড়া একই সময়ে সিলেটের জৈন্তাপুরে সারিঘাটে সারি নদী বিপৎসীমার দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সারি নদীর এই পয়েন্টে পানি বেড়েছে দশমিক ৪১ সেন্টিমিটার।

সিলেটের বেশিরভাগ নদ-নদীতে দ্রুত পানি বাড়ায় গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের সঙ্গে সবকটি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নিম্নাঞ্চলের ৯০ শতাংশ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।

মঙ্গলবার সকাল থেকে উপজেলার প্রতিটি নদ-নদী ও হাওর অঞ্চলে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ভারতের মেঘালয় এলাকায় অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত হওয়ায় সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রতিটি এলাকায় কৃষি জমিসহ রাস্তাঘাট বন্যার পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এ কারণে সড়কপথে সিলেট জেলা শহরের সঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলার যোগাযোগ ও উপজেলা সদরের সঙ্গে ১২টি ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাহাড়ি ঢলের পানি সারি-পিয়াইন ও ডাউকি নদী দিয়ে এলাকায় ঢুকছে। এতে পূর্ব জাফলং, মধ্য জাফলং, পশ্চিম জাফলং, পূর্ব আলীরগাঁও, পশ্চিম আলীরগাঁও, রুস্তমপুর, লেঙ্গুড়া, ডৌবারি, তোয়াকুল, নন্দীরগাঁও, ও সদর ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। গোয়াইনঘাট উপজেলার সদরের সঙ্গে সিলেট জেলা শহরে যাতায়াতের দুটি সড়ক সারী-গোয়াইন ও সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে উপজেলার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষা কার্যক্রম।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গোয়াইনঘাটে এবারের বর্ষা মৌসুমের শুরুতে কয়েক দফায় বন্যাকবলিত হয়। গত মঙ্গলবার রাতে প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় বুধবার সকাল থেকে জাফলংয়ের পিয়াইন নদ ও ডাউকি নদী দিয়ে সীমান্তের ওপার থেকে পাহাড়ি ঢল নামা শুরু হয়। অপরদিকে জৈন্তাপুরের সারী এলাকায় সারী নদীর পানি বেড়ে বাঘের সড়কের মুখ প্লাবিত হয়ে পড়ে। দুপুরের দিকে ওই সড়কের অন্তত ছয়টি স্থানে পানি উঠেছে। এতে সড়ক দিয়ে কোনো ধরনের যানবাহন চলাচল করছে না।

উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ করে বলা হয়েছে গোয়াইনঘাটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। অতি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে পানি আরও বাড়তে পারে। হাওর এলাকায় বজ্রপাতের সম্ভাবনা বেশি, অপ্রয়োজনে কাউকে বাইরে না থাকার অনুরোধও করা হয়েছে।

এদিকে, গোয়াইনঘাটের বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদের নির্দেশনায় ৪৪ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার শ্যামল কুমার রায় বলেন, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। পুরো হিসাব এখনো বলা যাচ্ছে না। বিদ্যালয়গুলোতে চলমান পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান বলেন, কয়েক দিন ধরে অতিমাত্রায় বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আশা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বিভিন্ন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। সার্বক্ষণিক বন্যাকবলিত এলাকার খোঁজ-খবর নিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি নজরদারি করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বন্যায় জনগণের দুর্ভোগ লাগবে আশ্রয়কেন্দ্র ও শুকনো খাবারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

এদিকে, কানাইঘাট উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ও পশ্চিম, চতুল, সদর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার রাত থেকে কানাইঘাট পৌর শহরের পূর্ব বাজারে পানি প্রবেশ করায় অনেক দোকানপাট তলিয়ে গেছে। সীমান্তবর্তী আরেক উপজেলা জকিগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলোতে শত শত মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

সীমান্তবর্তী কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়া পাশাপাশি রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে।

কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত চক্রবর্তী জানান, উপজেলা সদরের রাস্তায় পানি উঠেছে।

জৈন্তাপুরের স্থানীয় সাংবাদিক রেজওয়ান করিম সাব্বির বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে জৈন্তাপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এর ফলে চরম দুর্ভোগে আছেন উপজেলার পানিবন্দি হয়ে পড়া লোকজন।

বৈশাখী নিউজ/ বিসি