আক্কেলপুরে ৫শত বছরের ঐতিহ্যবাহী গোপীনাথপুর মেলা!

আপডেট: March 13, 2023 |
Boishakhinews24.net 224
print news

দেব্রত মন্ডল, আক্কেলপুর (জয়পুরহাট) প্রতিনিধিঃ জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুরে দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে গোপীনাথ মন্দির প্রাঙ্গণে ১৩ দিন ব্যাপী মেলা শুরু হয়েছে। দোল পূর্ণিমা উৎসব ও মেলাকে ঘিরে আনন্দে মেতেছে উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রাম। এই মেলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রশাসনের পাশাপাশি তৎপর স্থানীয়রা।

পাঁচশত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী গোপীনাথের এই মেলায় ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যবসায়ী ও ক্রেতা বিক্রেতার আগমন ঘটতো, জানা যায় এই মেলায় উট, ঘোড়া, দুম্বা, গরু, মহিষসহ বিভিন্ন প্রাণির সমাগম হতো কালের বিবর্তনে মেলাটি ছোট হয়ে এসেছে।

বর্তমানে বিভিন্ন জেলা থেকে শুধু ঘোড়া, মহিষ, গরু, ছাগল, ভেড়ার প্রচুর আমদানী ঘটে। এখানে ক্রেতা বিক্রেতারা কেনা বেচা করেন। দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীদের পদচারণায় মূখরিত হয়ে উঠে এ মেলা প্রাঙ্গণ।

গোপীনাথের প্রধান মন্দির থেকে শ্রী শ্রী গোপীনাথ জীউ প্রতিমা বাজার মন্দিরে ঢাক ঢোল সানাই কাশি বাজিয়ে আগমনের মধ্য দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের গোপীনাথপুরে দোলযাত্রা মেলা শুভ সূচনা হয়। রীতি অনুযায়ী গোপীনাথপুর বাজার মন্দিরে শ্রী শ্রী গোপীনাথ জীউ অবস্থান পর্যন্ত ১৩ দিন ব্যাপী চলবে এই মেলা। আবার ১৩দিন পর পুনরায় ফিরে যাবেন প্রধান মন্দিরে।

মেলাকে ঘিরে ইতোমধ্যেই মন্দিরের একশ একর জায়গা জুড়ে জমির উপরে বসেছে গরু, মহিষ, ঘোড়া, ছাগল ও ভেড়ার হাট। চলছে পুরো দমে বেচা-কেনা।

এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসেন নানা বয়সের দর্শনার্থীরা। মানুষের কাছে গরু, মহিষের পাশাপাশি আকর্ষণীয় ও ছোট বড় সকলের মজার একটি খোরাক হলো ঘোড়া দৌড় খেলা। এই ঘোড়া দৌড় খেলা দেখতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে ছোট ছোট শিশুরাসহ হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। যে ঘোড়া যেমন দৌড়ায়, সেই ঘোড়ার দামও আকাশ ছোঁয়া হয়।

নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থেকে আসা ঘোড়া ব্যবসায়ী মোঃ শাহারিয়া ইসলাম বলেন, “আমরা বাব-দাদার আমল থেকে এ মেলায় ঘোড়া ক্রয়-বিক্রয় করে আসছি, আমি এবার ছয়টি ঘোড়া নিয়ে এসেছি, তার মধ্যে এ পর্যন্ত একটি ৫০ হাজার ও অপরটি ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। এবার মেলায় ক্রেতা কম হওযায় এখন পর্যন্ত বাকী ঘোড়া গুলো বিক্রি করতে পারছি না। আমার “কদম রানী“ নামক ঘোড়াটি মেলায় ঘোড়া দৌড়ে সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু বর্তমান বাজার অনুযায়ী দাম ২ লক্ষ টাকা। ক্রেতার চাহিদা না থাকায় দাম হাকাচ্ছে মাত্র ১লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। ক্রেতা কম থাকায় আমার “কদম রানী” ঘোড়াটিকে বাসায় ফেরত নিয়ে যেতে হবে।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা ঘোড়া বিক্রেতা ডালিম বলেন, মেলায় আমার “বাদশা” নামক ঘোড়াটি ৫ লক্ষ টাকা দাম ধরা হয়েছে। ক্রেতার অভাবে ঘোড়াটি এখন পর্যন্ত বিক্রয় করতে পারিনি। তবে “মহারাজা” নামক ঘোড়াটি ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রয় করেছি।

জয়পুরহাট জেলার ধারকী গ্রামের মহিষ ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন জানান, “প্রতি বছর এই মেলায় মহিষ নিয়ে এসে বেচা কেনা করি। এবার ১০ জোড়া মহিষ বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছি। এখন পর্যন্ত ৫ জোড়া বিক্রি করেছি। এর মধ্যে এক জোড়া মহিষ সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি।”

নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থেকে আসা মহিষ বিক্রেতা সাকিব উল্লাহ বলেন, “আমরা তিন পুরুষ থেকে এই মেলায় মহিষ ক্রয়-বিক্রয় করি। এবার মেলায় ১১ জোড়া মহিষ বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছি। করোনার কারণে মেলা পর পর ২বছর না হওয়ায় ক্রেতা কম থাকায় এপর্যন্ত ৬ জোড়া মহিষ বিক্রি করেছি। লোকসান নিয়ে বাড়ি ফেরত যেতে হবে। এমন ভাবে চলতে থাকলে একসময় মহিষের হাট বিলিন হয়ে যাবে।”

গোপীনাথের মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গরু-মহিষ, ভেড়া ও ঘোড়া বেচা-কেনা। সৌখিন কাঠের আসবাবপত্র, বিভিন্ন রকম মসলাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্রপাওয়া যায়। আরও রয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দেশী-বিদেশী কম্বলের দোকান, কাঠের আসবাবপত্র ও বাহারী মিষ্টির দোকান। প্রতিবারের মতো এবারো মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বাহারী সামগ্রী মোটরসাইকেল খেলা, নাগরদোলাসহ খেলা-ধুলার ব্যবস্থা রয়েছে।

শ্রী শ্রী গোপীনাথ জীউ মন্দিরের সেবায়েত শ্রী রনেন্দ্র কৃষ্ণ প্রিয়া বলেন, “এই ঐতিহাসিক মেলা দোল পূর্ণিমাকে ঘিরে আদিকাল থেকে হয়ে আসছে। পর পর করোনার কারনে ২বছর মেলা না হওযায় গতবছর এবং এবারও মেলায় ক্রেতা বিক্রেতার সমাগম কম।”

গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেলা কমিটির সভাপতি হবিবুর রহমান বলেন, “গোপীনাথপুর ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম মেলা। মেলা ঘিরে মানুষের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। ব্যাপক জনসমাগম হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি মেলা কমিটিও মেলার সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।”

আক্কেলপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু বক্কর সিদ্দীক বলেন, “ঐতিহ্যবাহী গোপীনাথের মেলাকে ঘিরে এলাকার আইনশৃংখলা বজায় রাখতে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। যাতে করে মেলায় কোন প্রকার অপ্রিতিকর ঘটনা না ঘটে এবং মেলার পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে থাকে।”

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর